নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে বিএনপি। সরকারের তরফ থেকে এরই মধ্যে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচির যে ধারণা দেওয়া হয়েছে, সেটিকে ‘অস্পষ্ট ও হতাশাজনক’ বলে মনে করে দলটি। বিএনপি মনে করে, ‘পতিত’ ফ্যাসিবাদীদের দেশবিরোধী নানামুখী ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবিলায় নির্বাচনই এখন সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত এবং সেদিকেই তাদের ফোকাস করতে হবে। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠিত হয়েছে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এখনো সুনির্দিষ্টভাবে দিনক্ষণ না বলায় নির্বাচনের উদ্যোগ নিতে পারছে না ইসি। তাই নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং সরকারের ওপর রোডম্যাপের চাপ অব্যাহত রাখার অংশ হিসেবে বড় বড় সভা-সমাবেশ করার চিন্তাভাবনা করছে বিএনপি। গত বুধবার অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বেশ কয়েকজন নেতা এমন প্রস্তাব দেন। কারণ সরকারের অবস্থান স্পষ্ট না হওয়ায় ইসি গঠনের পরও নির্বাচন নিয়ে তারা এখনো পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছেন না।
বিএনপি এখন রাষ্ট্র মেরামতের দলীয় রূপরেখা ৩১ দফাকে নতুন করে ব্র্যান্ডিংয়ে ব্যস্ত। এ নিয়ে বিভাগীয় প্রশিক্ষণ কর্মশালার পর এখন জেলাভিত্তিক কর্মশালা চলছে, যেখানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হচ্ছেন। জেলা পর্যায়ে এ কার্যক্রম শেষ হলে তখন নির্বাচনের দাবিতে আরও সোচ্চার হবে দলটি। এর অংশ হিসেবে সারা দেশে সভা-সমাবেশ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এর দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত না হলেও আগামী ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ মাঠে নামতে পারে বিএনপি।
জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ ইস্যুতে সম্ভাব্য কী কর্মসূচি দেওয়া যায়, তা নিয়ে কয়েকজন প্রস্তাব দেন। কেউ কেউ বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ সরকার ফেল করলে সেটি হবে সামগ্রিক ব্যর্থতা। বিএনপি এই সরকারকে ব্যর্থ দেখতে চায় না। তারা চায়, সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে তাদের কাজ সম্পন্ন করুক।
বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর অব্যাহত দাবির মধ্যে বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে একটা ধারণা দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে তিনি বলেন ‘মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।’ জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার এই ভাষণ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার এই ভাষণ নিয়ে দলের কোনো নেতাই সন্তোষ প্রকাশ করেননি। নেতারা মনে করেন, সরকার নির্বাচনের জন্য ২০২৫ সালের শেষ থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত যে সম্ভাব্য সময়ের ধারণা দিয়েছে, সেটি দীর্ঘ সময়। যেটা নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের সময়ক্ষেপণ এবং নির্বাচনকে প্রলম্বিত করারই অংশ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো প্রাথমিকভাবে এবং প্রধানতম সংস্কার বলে মনে করি। এই সরকারের প্রধান ও প্রথম দায়িত্ব হলো একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়া। আর সেজন্য কিছু আইনি সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও মাঠের সংস্কার দরকার আছে। আমরা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে দেখেছি, এ ক্ষেত্রে সংস্কারে চার থেকে ছয় মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান, গণতান্ত্রিক যাত্রাপথে আমরা যেন কোনো কৌশল প্রয়োগ না করি। ভোটের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব, নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার সেরে ভোটের আয়োজন করতে হবে। তার মতে, নির্বাচনমুখী সংস্কার কার্যক্রম শেষে নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য তিন থেকে চার মাসের বেশি যৌক্তিক সময় লাগার কথা নয়।
জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিএনপির কেউ কেউ অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, সরকার দ্রুত নির্বাচন চায়। এ ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতারা সরকারের ওপর অযাচিত চাপ তৈরির চেষ্টা করছে। নির্বাচন বিলম্বের এটিও অন্যতম কারণ। নেতারা মনে করেন, এ বিষয়টি সরকারকেই মোকাবিলা করতে হবে। ‘পতিত’ ফ্যাসিবাদের দেশবিরোধী নানা ষড়যন্ত্র এবং জনগণের চাহিদা ও প্রত্যাশার আলোকে ছাত্রদের রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝিয়ে আস্থায় নিতে হবে এবং এটি সরকারের দায়িত্ব।
বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে তারা কোনো তাড়াহুড়া করছেন না; বরং সরকারকে তারা সহায়তা করতে চান এবং করছেনও। এজন্য সরকারকে তারা যৌক্তিক সময় দিচ্ছেন। গত ১৫-১৬ বছর ধরে ভোটাধিকারবঞ্চিত জনগণ এখন যেহেতু ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছে, তা ছাড়া এতদিন নির্বাচনের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোরও আস্থা ছিল না; তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন সরকারের উচিত, রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। তাহলে দলগুলো একদিকে যেমন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারবে, অন্যদিকে সরকারের সংস্কার কার্যক্রমেও সহায়তা করতে পারবে। কারণ মেয়াদের প্রায় সাড়ে চার মাস অতিবাহিত হলেও সরকার সুনির্দিষ্টভাবে কী করতে চায়, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। নির্বাচনের ব্যাপারে তারা এখনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারেনি, এটিই দলটির হতাশার জায়গা। কারণ বিএনপি এই সরকারকে ব্যর্থ দেখতে চায় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের ধারা বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বিষয়ে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে, বিএনপি সেটিকে স্বাগত জানিয়েছে। বিএনপি মনে করে, ওই রায়ে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরলেও সেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার ফরম্যাট কী হবে, সেটি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন আছে। নেতারা বলছেন, দেশে পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়, সেটা যাতে না হয়, সেজন্য রাজনৈতিক মতৈক্য প্রয়োজন, যাতে এই ব্যবস্থাকে আরও গ্রহণযোগ্য ও শক্তিশালী করা যায়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েও আলোচনা হয়। দলটির নেতারা মনে করেন, যে কারোই নতুন দল করার অধিকার রয়েছে, ছাত্ররাও সেটা করতে পারে। সেই দল যদি পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের পুনর্বাসনের প্ল্যাটফর্ম না হয়, তাহলে ছাত্রদের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানাবে বিএনপি। তা ছাড়া নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে দোষ দেখেন না বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। গত সেপ্টেম্বরে নয়াপল্টনে দলের এক সমাবেশে তিনি বলেন, কেউ যদি মনে করেন, একটি উন্নত এবং নিরাপদ বাংলাদেশের জন্য আরও নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন রয়েছে, তাতেও দোষের কিছু নেই। কারণ শেষ পর্যন্ত, জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে, তারা কাকে সমর্থন জানাবে কিংবা কাকে সমর্থন দেবে না।