আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আনা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত আপিলের ওপর রায় ঘোষণা করা হবে। এটি আপিল বিভাগের
কার্যতালিকার প্রথমে রয়েছে। গত ১১ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত সাত বিচারকের আপিল বেঞ্চ রায় ঘোষণার এদিন ধার্য করেন।
বেঞ্চের অন্য বিচারকরা হলেন– বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এসএম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
২০১১ সালের ১০ মে খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বেঞ্চ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেছিলেন। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশের আগেই ২০১১ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি ও ৫৫টি সংশোধনীসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয় এবং ৩ জুলাই তা অনুমোদন দেন রাষ্ট্রপতি।
পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে একাধিক রিভিউ আবেদন জমা পড়ে। গত বছরের ২৭ আগস্ট একটি আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান। একই বছরের ১৬ অক্টোবর আরেকটি আবেদন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর ২৩ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারও একটি রিভিউ আবেদন করেন। এছাড়া নওগাঁর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেনও আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত বছর একটি আবেদন করেন।
এ চার রিভিউ আবেদনের একসঙ্গে শুনানি শেষে নতুন করে আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত দেয় আপিল বিভাগ। এরপর গত ২১ অক্টোবর আপিলের শুনানি শুরু হয়।
আদালতে সুজনের বদিউল আলম মজুমদারের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া। বিএনপির মহাসচিবের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি গোলাম পরওয়ারের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। ইন্টারভেনর হিসেবে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মহসিন রশিদ ও এহসান এ সিদ্দিক। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলকারী নওগাঁর রানীনগরের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেনের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বদরুদ্দোজা বাদল ও শাহরিয়ার কবির। এ ছাড়া রিভিউ আবেদনকারী হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক।
শুনানিতে ড. শরীফ ভুইয়া বলেন, আমরা এখন যে অবস্থায় আছি সাংবিধানিকভাবে সেটা কার্যকর করা সম্ভব নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে এলেও এবার, অর্থাৎ ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন এ ব্যবস্থায় করার সুযোগ নেই। কারণ সংসদ ভাঙার পর ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধান থাকলেও সংসদ ভেঙে গেছে এক বছরেরও বেশি সময় আগে।
একই মত দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল এবং জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির।
আদালতের নির্দেশনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট শরীফ ভুইয়া বলেন, কনফিউশন এড়াতে আদালত বিষয়টি পর্যবেক্ষণ দিয়ে স্পষ্ট করে দিতে পারে। না হলে রায়ের ভিন্ন ব্যাখ্যা থেকে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। আদালত ব্যাখ্যা না দিলেও ব্যাখ্যা এটাই দাঁড়ায়—এ নির্বাচনে কেয়ারটেকার সম্ভব নয়।
শরীফ ভুইয়া আরও বলেন, বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার পর যে রায় দিয়েছেন সেটি অবৈধ—এ প্রশ্নও এসেছে। আমরা বলেছি, বিচারকদের ওপর কাজের চাপ অনেক। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত দিলে জটিলতা তৈরি হতে পারে। এ বিষয়টি নিষ্পত্তি না করলেও চলবে।
বিএনপির আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে যে নির্বাচন, তা তত্ত্বাবধায়কের অধীনে হবে না। আদালতে আমরা বলেছি, পরবর্তী নির্বাচন থেকে এ বিধান কার্যকর হতে পারে।
জামায়াতের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনিরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরলেও ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই হবে। সংসদ ভাঙার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধান ছিল। সংসদ না থাকলে ভাঙার প্রশ্নই আসে না। এখন তো সে রকম পরিস্থিতি নেই। আর সংসদ ভেঙেছে এক বছরেরও বেশি সময় আগে। ফলে এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োগের সাংবিধানিক সুযোগ নেই।
তার মতে, বর্তমানে দেশ একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের তিনটি ম্যান্ডেট— বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন। সেই ধারাবাহিকতায়ই আসন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নতুন সংসদ গঠনের পর চাইলে আগের তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি পুনর্বহাল করা যেতে পারে অথবা জুলাই সনদের মেকানিজম অনুযায়ী নতুন কাঠামো গড়া যেতে পারে।
শিশির মনির বলেন, আমরা চাই আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরে আসুক। তবে কোনো পর্যবেক্ষণ নয়। কারণ বর্তমানে কার্যকর আইন ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া নেই।
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বিচারপতি খায়রুল হকের দেওয়া রায় থাকা উচিত নয়, কারণ তা একটি রাজনৈতিক দলকে সুবিধা দিতে লেখা হয়েছিল। এটি বর্তমান সরকারের পর যে সরকার আসবে, সেখান থেকে কার্যকর হলে আইনের ব্যত্যয় হবে না।
১৯৯৬ সালের ২৭ মার্চ ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে তখনকার বিএনপি সরকার। এ সংশোধনীর বৈধতা প্রশ্নে ১৯৯৮ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন এম সলিম উল্লাহসহ তিন আইনজীবী। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রুল দেন হাইকোর্ট। ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা রায় দেয় হাইকোর্ট। পরে হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে আপিল বিভাগে আপিল করে রিটকারীপক্ষ।
২০১০ সালের ১ মার্চ আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে আটজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শুনানিতে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির পক্ষে মত দেন। শুনানি শেষে ওই বছরের ১০ মে আপিল মঞ্জুর করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় আপিল বিভাগ। তবে রায়ের দিন আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে অভিমত দিয়েছিলেন বিচারপতি খায়রুল হক। যদিও পূর্ণাঙ্গ রায়ে সেই পর্যবেক্ষণ ছিল না। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই ২০১১ সালের ৩০ জুন আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তিসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রস্তাব পাস করিয়ে নেয়। একই বছরের ৩ জুলাই রাষ্ট্রপতি তাতে অনুমোদন দেন।
গত ১৭ ডিসেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ পঞ্চদশ সংশোধনীর ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানবিরোধী ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। ফলে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরার পথ তৈরি হয়।


