বর্তমানে ৪৫০ কোটি মানুষ অপরিহার্য স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এক কোটি ১০ লাখ স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে আশার খবর হলো—এই ঘাটতি পূরণ এবং
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবায় বিপ্লব ঘটাতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। এমনকি এটি আমাদেরকে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের পথে এগিয়ে দিতে পারে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ‘দ্য ফিউচার অব এআই-এনাবল্ড হেলথ : লিডিং দ্য ওয়ে’ শীর্ষক শ্বেতপত্রে বলা হয়, প্রযুক্তি দ্রুত বিকশিত হলেও অন্যান্য শিল্পের তুলনায় স্বাস্থ্যসেবা খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গ্রহণ এখনও গড়পড়তার চেয়েও কম।
ডব্লিউইএফ জানায়, এআই নির্ভর ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবাগুলো বিশ্বব্যাপী দক্ষতা বৃদ্ধি, খরচ কমানো এবং স্বাস্থ্যগত ফলাফল উন্নত করার ক্ষমতা রাখে। চিকিৎসাসেবা খাতে ইতোমধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, এমন সাতটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো।
মস্তিষ্কের স্ক্যান ব্যাখ্যা করতে পারে এআইঃ-
স্ট্রোকের রোগীদের মস্তিষ্কের স্ক্যান পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে পেশাদার চিকিৎসকদের তুলনায় একটি নতুন এআই সফটওয়্যার ‘দ্বিগুণ নির্ভুল’ ফলাফল দিতে পারে। যুক্তরাজ্যের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ৮০০ জন স্ট্রোক রোগীর মস্তিষ্কের স্ক্যানের একটি ডেটাসেটের ওপর সফ্টওয়্যারটিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
এরপর ওই সফটওয়্যারটি দুই হাজার রোগীর ওপর পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়। এর ফলাফল ছিল চমকপ্রদ। এআই মডেলের সফটওয়্যারটি নির্ভুলতার পাশাপাশি স্ট্রোকটি কোন সময় হয়েছিল তা-ও শনাক্ত করতে সক্ষম, যা চিকিৎসকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
কনসালট্যান্ট নিউরোলজিস্ট ডা. পল বেন্টলি ‘হেলথ টেক নিউজকে’ বলেন, রক্ত জমাট বাঁধার কারণে সৃষ্ট বেশিরভাগ স্ট্রোকের ক্ষেত্রে (স্ট্রোক হওয়ার) সাড়ে চার ঘণ্টা পর্যন্ত রোগীর চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার সম্ভব হয়। ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত রোগীকে অস্ত্রোপচার করা যায়। তবে এই সময়ের পরে আর এই চিকিৎসাগুলো কোনো উপকারে আসবে কিনা তা বলা কঠিন। তাই ডাক্তারদের জন্য প্রাথমিকভাবে স্ট্রোকের শুরু হওয়ার সময় জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষের তুলনায় এআই ভাঙা হাড় শনাক্তে বেশি কার্যকরীঃ-
কিছুটা আশ্চর্যজনক হলেও জরুরি সেবা প্রদানকারী চিকিৎসকরা ১০ শতাংশ পর্যন্ত ঘটনায় ভাঙা হাড় খুঁজে পান না। তাই প্রাথমিক স্ক্যান করার জন্য এআই ব্যবহার করলে অপ্রয়োজনীয় এক্স-রে এবং ভাঙা হাড় শনাক্তে ভুল হওয়া এড়ানো সম্ভব।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেলথ অ্যান্ড কেয়ার এক্সিলেন্স (এনআইসিই) বলেছে, এআই নির্ভর এই প্রযুক্তি নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য। এটি ফলো-আপ চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা কমাতে পারে।
স্বাস্থ্যসেবায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত প্রবর্তন নিয়েও কিছু উদ্বেগ রয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর এথিক্স ইন এআইয়ের ডা. ক্যারোলিন গ্রিন সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেন, এআই নির্ভর টুল ব্যবহারকারীদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, অর্থাৎ তারা যেন জানে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা থেকে আসা ঝুঁকিগুলো কীভাবে কমাতে হয়। কারণ ভুল তথ্য দেওয়ার আশঙ্কাও থাকে।
অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এআইঃ-
যুক্তরাজ্যে প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কাদের হাসপাতালে যেতে হবে বা যেতে হবে না; তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব প্যারামেডিকদের। তাদের সর্বদা জানতে হয়, হাসপাতালে কতটি বেড খালি আছে।
ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সঠিকভাবে রোগীদের হাসপাতালে স্থানান্তরের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আগাম তথ্য দিতে পারে। এআই সফটওয়্যারটিকে রোগীর নড়াচড়া, পালস ও রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা এবং বুকব্যথার মতো বিষয়গুলোর ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে এটি সঠিকভাবে তথ্য দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। তবে এনআইসিই সতর্ক করে বলেছে, এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহারের আগে আরও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে।
এক হাজারের বেশি রোগের প্রাথমিক লক্ষণ শনাক্তকরণঃ-
নতুন একটি এআই নির্ভর সফটওয়্যার রোগীর দেহে লক্ষণ প্রকাশের আগেই নির্দিষ্ট কিছু রোগের উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারে। সফটওয়্যারটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকা এ তথ্য জানিয়েছে। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য তথ্য ভান্ডারে থাকা পাঁচ লাখ মানুষের চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত তথ্য ব্যবহার করে এটি উচ্চ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অনেক বছর পরে নির্দিষ্ট ব্যক্তির একটি রোগ ধরা পরার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে।
গবেষক স্লাভ পেট্রোভস্কি স্কাই নিউজকে বলেন, রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পরই মানুষ ডাক্তারের কাছে যায়। কিন্তু এই এআই মডেল রোগের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার অনেক আগেই তথ্য দিতে পারে। আলঝেইমার, ফুসফুসের রোগ, কিডনি রোগসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে এটি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে।
যুক্তরাজ্যের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, একটি এআই টুল মৃগীরোগীর মস্তিষ্কের রেডিওলজিস্টরা খুঁজে না পাওয়া ক্ষতগুলোর ৬৪ শতাংশ সফলভাবে শনাক্ত করতে পারে। বিশ্বজুড়ে এক হাজার ১০০ জনের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুর এমআরআই স্ক্যানের ওপর প্রশিক্ষিত এআই টুলটি একজন ডাক্তারের চেয়ে দ্রুত ক্ষত শনাক্ত করতে সক্ষম এবং মানুষের চোখ এড়িয়ে যাওয়া ক্ষুদ্র ও অস্পষ্ট ক্ষতগুলোও এটি বের করতে পারে।
গবেষক ড. কনরাড ওয়াগস্টাইল বিবিসিকে বলেন, ‘এআই প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষত খুঁজে পায়, যা ডাক্তাররা পারেননি। কিন্তু এক তৃতীয়াংশ ক্ষত খুঁজে পাওয়া এখনও সত্যিই কঠিন।’
গবেষকরা বলছেন, এআইয়ের ফলাফলের সঙ্গে মানুষের তত্ত্বাবধান এবং দক্ষতার সমন্বয় রোগ নির্ণয় ও নিরাময়কে ত্বরান্বিত করবে।
স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্লিনিক্যাল চ্যাটবটঃ-
চিকিৎসকদের অবগত করা এবং দ্রুত চিকিৎসা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলোকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ত্বরান্বিত করতে পারে। তবে এটি সবসময় নির্ভুল তথ্য না-ও দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, চ্যাটজিপিটি, ক্লড বা জেমিনির মতো স্ট্যান্ডার্ড লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (এলএলএম) চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রশ্নের পর্যাপ্ত প্রাসঙ্গিক বা প্রমাণ-ভিত্তিক উত্তর দিতে অক্ষম।
তবে চ্যাট আরডব্লিউডি রিট্রিয়েবল-অগমেন্টেড জেনারেশন (আরএজি) সিস্টেম ৫৮ শতাংশ প্রশ্নের কার্যকর উত্তর দিতে পেরেছে, এলএলএম-এর ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে মাত্র ২-১০ শতাংশ।
২০২৪ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ডিজিটাল হেলথকেয়ার ট্রান্সফরমেশন ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে রোগীদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ‘হুমার’ ওপর একটি জরিপে দেখা গেছে, এটি রোগীদের পুনরায় ভর্তির হার ৩০ শতাংশ কমাতে পারে। এ ছাড়া রোগীদের পর্যালোচনার সময় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের কাজের চাপ কমাতে পারে।
এআই ও প্রচলিত চিকিৎসাঃ-
শুরুর দিকে এআই ও প্রচলিত ওষুধের মেলবন্ধন অসম্ভব বলে মনে হতে পারে, কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে—এই দুটি একে অপরের পরিপূরক হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও এর অংশীদারদের ‘প্রচলিত চিকিৎসায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখানো হয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে প্রচলিত, পরিপূরক ও সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি করতে পারে।
প্রথম দেশ হিসেবে ভারত ‘ট্র্যাডিশনাল নলেজ ডিজিটাল লাইব্রেরি’ চালু করেছে, যেখানে স্থানীয় চিকিৎসা পদ্ধতি তালিকাভুক্তি ও বিশ্লেষণের জন্য এআই টুল ব্যবহার করা হয়েছে। দেশটিতে আধুনিক রোগ মোকাবিলায় কোনো ভেষজ ওষুধ সাহায্য করতে পারে কিনা, তা এআই ও আয়ুর্জেনোমিক্সের (প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদের সঙ্গে আধুনিক জিনোমিক চিকিৎসা পদ্ধতির সমন্বয়) মাধ্যমে গবেষণা করে দেখা হচ্ছে।
একইভাবে ঘানায় গবেষকরা ঔষধি গাছপালা শনাক্তকরণ এবং শ্রেণিবদ্ধকরণে সহায়তার জন্য একটি এআই মডেল ব্যবহার করছেন। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় রক্তের বিভিন্ন জটিলতার চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রচলিত ওষুধ বিশ্লেষণে এআই ব্যবহার করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবা খাতের এডমিনদের জন্য এআইঃ-
চিকিৎসা খাতের প্রশাসনিক কাজ অনিবার্য ও সময়সাপেক্ষ। এআই কো-পাইলট ব্যবহার করলে চিকিৎসকরা রোগীদের ওপর আরও বেশি সময় মনোযোগ দিতে পারবেন।
মাইক্রোসফট সম্প্রতি ‘ড্রাগন কো-পাইলটের’ ঘোষণা দিয়েছে। এটি এআই নির্ভর স্বাস্থ্যসেবা টুল, যা চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত পরামর্শ শুনতে এবং নোট তৈরি করতে পারে। গুগল ইতোমধ্যে স্বাস্থ্যসেবার কিছু প্রশাসনিক বোঝা কমাতে বিশেষভাবে তৈরি একটি এআই মডেলের টুল তৈরি করেছে।
জার্মানিতে এলিয়া (Elea) নামের একটি এআই প্ল্যাটফর্ম রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রোগ শনাক্তের সময় কয়েক সপ্তাহ থেকে কমিয়ে কয়েক ঘণ্টা করেছে। এলিয়ার প্রতিষ্ঠাতারা বলছেন, প্রযুক্তি বাধা নয়, মিত্র হতে পারে। এলিয়ার সহপ্রতিষ্ঠাতা ড. সেবাস্তিয়ান কাসু ইইউ-স্টার্টআপসকে বলেন, কেউই ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রশাসনিক কাজে ব্যয় করার জন্য স্বাস্থ্যসেবা খাতে যোগ দেয় না।
ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া এবং নোট শোনার জন্য এআই টুল অবশ্য সবার কাছে আকর্ষণীয় নয়। যুক্তরাজ্যে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ২৯ শতাংশ মানুষ মৌলিক স্বাস্থ্য পরামর্শ প্রদানের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর আস্থা রাখেন। যদিও দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ চিকিৎসকদের সময় বাঁচাতে এআই প্রযুক্তি ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এর মধ্যে কারও কারও সঠিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
গত বছরের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওপেনএআইয়ের হুইসপার (Whisper) অনেক হাসপাতালে রোগীর সাক্ষাৎকারের সারসংক্ষেপ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু এটি কিছু ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি করেছে। এজন্য এআই টুলগুলো নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাজ্যে এআই-চালিত চিকিৎসা ডিভাইসগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে মেডিসিন অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্ট রেগুলেটরি এজেন্সি।
যুক্তরাষ্ট্রে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) গত বছর স্বাস্থ্যসেবায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জানায়, যদিও এফডিএ নিরাপদ, কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য এআই টুল নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে যাবে, তবুও সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে কঠোরতার সঙ্গে এআইয়ে মনোযোগ দেওয়া অপরিহার্য।


