আওয়ামী লীগের নৌকা যে টানা চতুর্থবার জয়ের বন্দরে ভিড়তে যাচ্ছে, তা নিয়ে কোনো সংশয় কারো ছিল না। জল্পনা-কল্পনা ছিল দ্বিতীয় অবস্থান নিয়ে, সেখানে চমক দেখালেন আওয়ামী লীগেরই স্বতন্ত্ররা। বিএনপিসহ নিবন্ধিত ১৫টি দলের বর্জনের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম ভোটারের উপস্থিতিতে ‘শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচনে আবারও দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে আওয়ামী লীগ; ভোট হওয়া ২৯৮ আসনের মধ্যে ২২৩টি পেয়ে টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করতে যাচ্ছে দলটি। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। আর এবার নিয়ে টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন তিনি।
তবে ভোটের পর প্রাপ্ত ফল দেখে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল কে হবে বা কারা হবে? এ পর্যন্ত ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসনের বেসরকারি ফলাফল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২২৩টিতে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীনদের পর সবচেয়ে বেশি জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, ৬১টি আসনে (যাদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতা)। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি জয় পেয়েছে ১১টি আসনে। আর অন্যান্য দলের মধ্যে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি জিতেছে একটি করে আসনে। প্রশ্ন হচ্ছে- সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এত কম আসনে জয়ী হওয়ায় বিরোধী দল কে হবে?
নির্বাচনের আগে অনেক নাটকীয়তা, দেনদরবার দেখেছে দেশবাসী। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬টি আসনে ছাড় পেয়েছিল জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা)। সব মিলে এবার ২৬৫টি আসনে প্রার্থী ছিল দলটির। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছাড় পাওয়া ২৬ আসনের ১১টিতে জিততে পেরেছেন জাপার প্রার্থীরা। সমঝোতার বাইরে কোনো আসনে দলের প্রার্থী জিততে পারেননি।
বর্তমানে দলটির ২৩ জন নির্বাচিত সংসদ সদস্য রয়েছেন। আর সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য রয়েছেন চারজন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কমে হয়েছে ১১।
আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬ আসনে ছাড় পেলেও ভরাডুবি হয়েছে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির। ছাড়ের আসনে নৌকার প্রার্থী না থাকলেও ১৫টিতে স্বতন্ত্রদের বিরুদ্ধে হেরেছে লাঙ্গল। জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরসহ অন্তত চারজনের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে সমঝোতার আসনে।
নির্বাচনের সকালে জি এম কাদের বলেছেন, ‘নির্বাচনে ডেকে এনে জাতীয় পার্টিকে কোরবানি দেওয়া হয়েছে।’
ফলে আগামী সংসদে আর দ্বিতীয় বৃহত্তম দল থাকছে না জাপা। লাঙ্গলের চেয়ে স্বতন্ত্রের এমপি বেশি হবে দ্বাদশ সংসদে। ফলে জাপা ফের বিরোধী দল হতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বহুবার বলেছেন, আওয়ামী লীগকে হারিয়ে তার দল সরকার গঠন করবে।
বিএনপিবিহীন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে ৩৪ আসন পেয়ে প্রথমবারের মতো প্রধান বিরোধী দল হয়েছিল জাপা। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে বিএনপির প্রায় চার গুণ ২২ আসন পেয়ে ফের বিরোধী দল হয় দলটি। এবারও বিএনপিবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে জাপা। কিন্তু ডামি প্রার্থীদের ভিড়ে দলটি পেয়েছে মাত্র ১১ জন সংসদ সদস্য।
প্রসঙ্গত, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৮টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। তার মধ্যে বেসরকারিভাবে ঘোষিত ২৯৮টি আসনের ফলাফল বিশ্লেষন করে দেখা গেছে, তিনটি দলের প্রার্থীরা নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। দল তিনটি হলো- আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও কল্যাণ পার্টি। বাকি ২৫টি দলের কোনো প্রার্থী জয়ের দেখা পাননি। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া ২৮টি দলের মধ্যে ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ ৩৯টি আসনে, ইসলামী ঐক্যজোট ৪২টি আসনে, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ৩০টি আসনে, গণফোরাম ৯টি আসনে, গণফ্রন্ট ২১টি আসনে, জাকের পার্টি ২১টি আসনে, জাতীয় পার্টি ২৬৫টি আসনে, জাতীয় পার্টি-জেপি ১৩টি আসনে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ ৬৬টি আসনে, তৃণমূল বিএনপি ১৩৫টি আসনে, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) ১২২টি আসনে, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ ১০টি আসনে, আওয়ামী লীগ ২৬৬টি আসনে, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ৩৭টি আসনে, বাংলাদেশ কংগ্রেস ৯৬টি আসনে, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ১৬টি আসনে, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ১১টি আসনে, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ৫টি আসনে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম ৫৬টি আসনে, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ৩৮টি আসনে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ ৫টি আসনে, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট ৪৫টি আসনে, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ৪টি আসনে, সুপ্রিম পার্টি ৭৯টি আসনে, সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট ৬৩টি আসনে, ওয়ার্কার্স পার্টি ২৬টি আসনে, সাম্যবাদী দল ৪টি আসনে ও গণতন্ত্রী পার্টি ১০টি আসনে প্রার্থী দেয়। আর স্বতন্ত্র ৪৩৬ জনসহ নির্বাচনে ১৯৭১ জন প্রার্থী অংশ নেয়।