রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বর থেকে একটু সামনে এগোলেই ডানপাশে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়। স্বাভাবিক সময়ে রাষ্ট্রীয় পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই ভবন ঘিরে চলে বিশাল কর্মযজ্ঞ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে ব্যস্ততা। কিন্তু বর্তমান চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানটিতে বন্ধ রয়েছে গ্রাহক পর্যায়ের সব ধরনের সেবা কার্যক্রম। এতে সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন হাজার হাজার গ্রাহক।
গতকাল সোমবার বিআরটিএ ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, ভেতর থেকে কার্যালয়ের গেট বন্ধ। পকেট গেট দিয়ে সকালে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিসে প্রবেশ করছেন। মূল ফটকের সামনের ফুটপাতসহ ভবনের ভেতরে আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। গেটের ডানপাশে সেবা কার্যক্রম বন্ধের কথা উল্লেখ করে ছোট্ট ব্যানার টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপরও ভবনের গেটে বেশ কয়েকজন গ্রাহককে সেবা নিতে আসতে দেখা গেছে।
কার্যালয়ের দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ চিঠি চালাচালি ছাড়া গ্রাহক পর্যায়ের সব সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে না জেনে কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন, কেউবা রেজিস্ট্রেশন, কেউবা পরীক্ষা সংক্রান্ত বা যানবাহনের ফিটনেসসহ তথ্য জানতে আসেন। তবে কবে থেকে সেবা কার্যক্রম চালু হবে, তা জানাতে পারেননি তারা।
জানা গেছে, দেশের ৬৪ জেলায় বিআরটিএ কার্যক্রম রয়েছে। রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত যানবাহন ৬১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫০। রাজধানীতে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত যানবাহন ২১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৭৫টি। নগরীতে বিআরটিএর চারটি কার্যালয় থাকলেও মূলত ঢাকা বিভাগের বড় কর্মযজ্ঞ পরিচালনা হয় মিরপুর অফিস ঘিরেই। এখানে স্বাভাবিক সময়ে নিয়মিত সেবা নিতে আসেন কমপক্ষে আড়াই হাজার মানুষ।
কিন্তু সহিংসতায় এ কার্যালয়সহ প্রতিষ্ঠানের বনানীর কেন্দ্রীয় দপ্তরে আগুন দেওয়ায় মূল সার্ভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে গত ১৮ জুলাই থেকে সব ধরনের সেবা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। ফলে সারা দেশে বিআরটিএ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কয়েক লাখ গ্রাহক। যদিও প্রতিদিন কী পরিমাণ গ্রাহক প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নেন, এর সঠিক পরিসংখ্যান বিআরটিএ দপ্তর থেকে পাওয়া যায়নি।
বিআরটিএ ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশসহ নানা মাধ্যমে সেবা কার্যক্রম বন্ধ থাকার বিষয়টি গ্রাহকদের জানানো হচ্ছে। তাই আগের মতো কার্যালয়ে ভিড় নেই। প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন গ্রাহক আসেন। তারা গেটে নোটিশ দেখে ফিরে যান।
বিআরটিএ ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক স্বদেশ কুমার দাস বলেন, কিছু গ্রাহক মিরপুর অফিসে প্রতিদিন আসেন, কার্যক্রম বন্ধ থাকায় তাদের বুঝিয়ে আমরা ফেরত পাঠাচ্ছি।
এদিকে, সেবা সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রের বৈধতার মেয়াদ দুই মাস বাড়িয়ে গত বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। সব মিলিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে ছয় বিভাগে ১৮ ধরনের সেবা দিয়ে থাকে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। এমন বাস্তবতায় কবে নাগাদ সেবা চালু হবে—এই উত্তরের অপেক্ষায় গ্রাহকরা।
এ ব্যাপারে বিআরটিএ চেয়ারম্যান গৌতম চন্দ্র পাল বলেন, সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সার্ভার চালুর কাজটি করছি। আশা করছি, দ্রুত পরীক্ষামূলকভাবে সার্ভার চালু করতে পারব। সব ঠিকঠাক থাকলে সীমিত পরিসরে সেবাগুলো চালু হবে।
সারা দেশে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতিদিনের কার্যক্রম দেখাভাল করে বিআরটিএ সদর দপ্তরের রোড সেফটি শাখা। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব ই রব্বানী বলেন, বিআরটিএর বেশিরভাগ কার্যক্রম এখন অনলাইনে পরিচালিত হয়। সেবা বন্ধ থাকার বিষয়টি গ্রাহকদের এসএমএস করেও জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে প্রতিদিন দেশে কত গ্রাহক সেবাবঞ্চিত হচ্ছে, সে তথ্য আমাদের কাছে নেই।
বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, স্বাভাবিক সময়ে এ অফিসে লাইসেন্সের জন্য ছয় শতাধিক গ্রাহক আসেন। যানবাহনের ফিটনেসের জন্য ছয় শতাধিক, রেজিস্ট্রেশনের জন্য দুইশ, মালিকানা বদল দুইশ, নম্বর প্লেটের জন্য তিনশ, তথ্যের জন্য দুই শতাধিক গ্রাহক ভিড় করেন। সবমিলিয়ে দুই হাজারের বেশি মানুষ প্রতিদিন শুধু এই কার্যালয়ে সেবা নিতে আসেন।
জানা গেছে, নাশকতায় এ কার্যালয়ে হেল্পডেস্ক, ২ ও ৩ নম্বর গেটের পাশের ছয়টি রুম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৪০ কোটি টাকায় বিদেশ থেকে আনা যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষার ভেহিক্যাল ইনস্পেকশন সেন্টার (ভিআইসি) মেশিন আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১২ লেনের ৯৫/১০০ টেস্টিং মেশিন, ৩০টি কন্ট্রোল স্টেশন ভাঙচুর, ১০টি পাওয়ার কন্ট্রোল বক্স, ২৪টি পিডিএ মেশিন, ছয় সেট আই আর ডিভাইস, আটটি ডিসপ্লে পুরোপুরি ভাঙচুর ও লুট করা হয়েছে।
সহিংসতায় অগ্নিকাণ্ড, ভাঙচুর ও লুটপাটে বিআরটিএ সদর দপ্তরে ৫৬ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। বিআরটিএ ভবনে স্থাপিত সার্ভার ও আইএস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তবে গত ১৬ জুলাই থেকে যাদের মোটরযান ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন, অগ্রিম আয়কর, রুট পারমিট, ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন সংক্রান্ত কাগজপত্রের মেয়াদ ১৯ জুলাই অতিক্রান্ত হয়েছে বা ১৫ সেপ্টেম্বর অতিক্রান্ত হবে, তাদের মোটরযানের উল্লিখিত সেবা সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রে বৈধতার মেয়াদ ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করে গত বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
এ ছাড়া অর্থ বিভাগের স্মারকের সম্মতির পরিপ্রেক্ষিতে জরিমানা ছাড়া মূল কর ও ফি জমা প্রদানপূর্বক সব ধরনের মোটরযানের কাগজপত্র (ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন ও রুট পারমিট) এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স হালনাগাদের সময়সীমা ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর কথা আরেকটি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।