রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণ ইস্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে ‘সন্ত্রাসী’ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে দলটি বলছে, এটি একটি সাহসী ও বিপ্লবী সিদ্ধান্ত। আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিগত দেড় দশকে ছাত্রলীগকে রাষ্ট্রীয় মদদে একটি দানব বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছিল। বিএনপি মনে করে, ছাত্রলীগের বিগত দেড় দশকের কর্মকাণ্ডই তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি দিয়েছে। সুতরাং সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। এ জন্য দেশের জনগণ সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।
ছাত্রলীগকে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী ‘সন্ত্রাসী সত্তা’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে গত বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের এই ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের বিরুদ্ধে কোটা সংস্কার ও সরকার পতন আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতা হত্যা ও অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করা এবং বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।
বিএনপি মনে করে, স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা থাকলেও স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের ছত্রছায়ায় দীর্ঘ সময়ব্যাপী হত্যাকাণ্ডসহ নানা ধরনের সহিংসতায় জড়িত হওয়ায় সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের এ সিদ্ধান্তটি খুবই যৌক্তিক ও যথাযথ এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ। তবে দলটি মনে করে, শুধু ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করাই চূড়ান্ত সমাধান নয়। ছাত্রলীগের হয়ে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। এটা জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তিনি বলেন, বর্বর হানাদার বাহিনীর মতো এরা বাংলাদেশের আন্দোলনকামী জনগণের ওপরে অত্যাচার-নির্যাতন, নির্বিচারে গুলি এবং হত্যা করেছে। কয়েক দশক ধরে ছাত্রলীগের ঐতিহ্য তাই। ফলে এই জাতি বর্তমানে ছাত্রলীগকে কোনো ঐতিহ্যবাহী সংগঠন মনে করে না, বরং সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবেই চেনে।
গতকাল সেগুনবাগিচার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি আয়োজিত এক সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেছেন, ছাত্রলীগকে শুধু নিষিদ্ধ করা সমাধান নয়। কারণ, তাদের হাতে দা, পিস্তল, অস্ত্র আছে। তারা কি যেখানে-সেখানে হামলা করবে না? তাই বলছি, এদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর আমরা একটু মুক্তি পেয়েছি, কিন্তু আমরা কি স্বস্তিতে আছি? আমরা একটা সংকট পেরিয়ে উঠেছি সত্যি, কিন্তু একটি ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছি। সাধারণ মানুষ আজ স্বস্তি পাচ্ছে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দাবি-দাওয়া নিয়ে অফিস ঘেরাও কর্মসূচি, পতিত স্বৈরাচারের দোসররা পরিকল্পনা মাফিক দেশকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে সরকার দেশকে ভালোভাবে পরিচালনা করতে না পারে, একটি সুন্দর নির্বাচন না দিতে পারে।
জুলাইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলার পরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সহিংস রূপ পায়। আন্দোলন দমাতে প্রকাশ্যে রাজপথে সংগঠনটির সশস্ত্র কর্মীদের কর্মকাণ্ডের ছবি সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবি ছিল, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা। দাবি মানতে সম্প্রতি সরকারকে আলটিমেটামও দিয়েছিলেন তারা। নির্ধারিত সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করল সরকার। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার ফলে এ সংগঠনটি আর কোনো সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে না।
ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের ঘটনায় ছাত্রদলসহ সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো এবং শিক্ষার্থীরা আনন্দ প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন জায়গায় আনন্দ মিছিল হয়েছে। একই সঙ্গে ছাত্রলীগকে দেখা মাত্রই তাদের পুলিশে সোপর্দ করার কথাও বলেছেন তারা।
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেন, ছাত্রলীগ একটি খুনি সংগঠন। খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, ভোট ডাকাতি থেকে শুরু করে গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে ছাত্রলীগ। সব জঙ্গি সংগঠন মিলে যত মানুষ খুন করেছে, ছাত্রলীগ এককভাবে তার চেয়ে বেশি মানুষ খুন করেছে। ছাত্রলীগ ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছিল। ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে ছাত্ররাজনীতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। শুধু ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা চূড়ান্ত সমাধান নয়। ছাত্রলীগের হয়ে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
এদিকে জুলাই-আগস্ট গণবিপ্লবে ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা চালানোর দায়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মহল থেকে আওয়ামী লীগকেও নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। আর ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে বিএনপি স্বাগত জানালেও মোটা দাগে কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধের পক্ষে নয়। দলটি মনে করে, দায়ী নেতাদের অপরাধের বিচার হতে পারে, কিন্তু দলকে নিষিদ্ধ করে কার্যত খুব ভালো ফল পাওয়া যায় না। কারণ, কোনো না কোনো ফরমেটে তারা ফিরে আসার চেষ্টা করে পরিস্থিতিকেও অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করবে। গত ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল তৎকালীন সরকার। তখন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। জনগণেরই দায়িত্ব তারা কার রাজনীতি গ্রহণ করবে, কার রাজনীতি গ্রহণ করবে না।