শনিবার, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪
শনিবার, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪
20 C
Dhaka
Homeবাংলাদেশসুন্দরবনে বাড়ছে লবণাক্ত পানি

সুন্দরবনে বাড়ছে লবণাক্ত পানি

প্রকাশ: জুন ৭, ২০২৪ ৯:৩৮

অতিরিক্ত লবণাক্ততাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কার্যত ধুঁকছে দেশের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ এবং বিশ্বের একমাত্র মিঠাপানির ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন।

বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত এ বনে মিঠাপানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ফলে মিঠাপানিনির্ভর গাছ ও মাছ মারা যাচ্ছে। বন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক দশকে লবণাক্ততা সুন্দরবনের গাছপালা এবং প্রাণিকুলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে।

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র বিশ্বের যে কোনো ম্যানগ্রোভ বনের তুলনায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ। সুন্দরী, পশুর, গেওয়া, গরানসহ ৩৫০ প্রজাতির গাছ রয়েছে এ বনে। রয়েছে প্রায় ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব ঐতিহ্যের এই সুন্দরবন তার বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে।

সম্প্রতি কয়েকটি গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে উদ্বেগজনক তথ্য। সেখানে দেখা গেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় সুন্দরবনের নদী-খাল ও বনভূমিতে লবণাক্ততা বেড়েছে। অতিরিক্ত লবণাক্ততায় জন্মাতে পারছে না অনেক লতাগুল্ম, যা বনের বড় অংশের প্রাণীর খাবার।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদন বলছে, ২০১২ সালে বনের বিভিন্ন নদী ও খালের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ৩ থেকে ১৮ দশমিক ৮ পিপিটি। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে ২০২২ সালে বেড়ে ১২ দশমিক ৮ থেকে ২৪ দশমিক ৫ পিপিটি পাওয়া গেছে। আর মাটিতে ৬ দশমিক ৯ থেকে বেড়ে হয়েছে ১২ পিপিটি লবণাক্ততা।

আর বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সুন্দরবনে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে ৯ বছরের ব্যবধানে বিভিন্ন গাছের চারা গজানোর হার কমেছে। ২০১০ সালে গড়ে প্রতি হেক্টরে সুন্দরীগাছের চারা গজিয়েছিল ৫ হাজার ৫৫৬টি। ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪ হাজার ১৯২টিতে। আর গরানগাছের চারা ৯ হাজার ৫৫৬টি থেকে কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৪৯৫টিতে।

এছাড়া সুন্দরবনের প্রায় ৪০ ভাগ সুন্দরী গাছে আগামরা রোগ ও ৫০ ভাগ পশুর গাছ হার্টরট বা ঢোর রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বিশেষ করে বনের বেশি লবণাক্ত এলাকায় বয়স্ক সুন্দরী গাছের আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। পশুর গাছ বেশি লবণাক্ত ও মৃদু লবণাক্ত উভয় এলাকাতেই ঢোর রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এই রোগে আক্রান্ত গাছের বাকল ঠিক থাকে, কিন্তু ভেতরের কাঠ পচে যায়।

প্রতিষ্ঠানটির ৩৩টি স্থায়ী স্যাম্পল প্লটের ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গেওয়া বৃদ্ধির হার ৭৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ আর সুন্দরী মাত্র ৫ দশমিক ০৫ শতাংশ।

এছাড়া বনের বিভিন্ন এলাকায় সুন্দরী গাছের আগা মরা, গেওয়া গাছের শেকড় পচন ও পশুরগাছের হার্টরট বা ঢোর রোগ বেড়েছে। তবে গাছের এসব রোগবালাইয়ের জন্য শুধু লবণাক্ততাকে দায়ী করছেন না বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ অফিসার ড. মমিনুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘সমন্বিত প্রভাবেই বাড়ছে বিভিন্ন গাছের রোগ। শুধু লবণাক্ততাকে দোষ দেয়া যাবে না। আর রোগের কারণ বিশ্লেষণে চলছে গবেষণা।’

তিনি বলেন, প্রতি বছর সুন্দরবনের ৩৩টি স্থায়ী স্যাম্পল প্লটের ৯৯০ বর্গফুট এলাকায় গাছের চারা গজানোর হার পর্যবেক্ষণ করা হয়। এতে এই চিত্র ফুটে উঠেছে। সুন্দরবনকে কম, মাঝারি ও বেশি- এই তিনটি এলাকায় ভাগ করা হয়েছে। দেখা গেছে, মাঝারি ও বেশি লবণাক্ত এলাকায় গাছের চারা গজানোর হার কমে গেছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলে আসছে পরিবর্তন। যে স্থানে আগে কম লবণসহিষ্ণু উদ্ভিদ নির্ভর প্রাণী ছিল তারা স্থান পরিবর্তন করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বনের মধ্যে জোয়ারের লবণাক্ত পানির চাপ বেড়েছে। সেই সঙ্গে উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে গেছে। এর ফলে বনের মাটি ও পানির লবণাক্ততা বেড়েছে। এর প্রভাবে বনের গাছপালার রোগব্যাধি বাড়ছে। গাছের রোগব্যাধির কারণ, রোগব্যাধির অবস্থা এবং প্রতিকারের উপায় নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।’

আর জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাবকে নেতিবাচক দেখছে বন বিভাগও। বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে সুন্দরবনের গাছপালা রোগাক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বনের জীববৈচিত্র্যে বিভিন্ন পরিবর্তন এসেছে। লবণাক্ততার কারণে অনেক স্থানে গাছের চারা ও বৃদ্ধির হার কমেছে। প্রাণীরা স্থান পরিবর্তন করছে। সুন্দরী গাছ কমে যাচ্ছে, গেওয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় খবর