শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগ দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে (সেভেন সিস্টার্স) সম্ভাব্য অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।গত বুধবার (১৩ নভেম্বর) করাচি থেকে সারাসরি পণ্যবাহী একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে। বাংলাদেশে পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ সরাসরি শিপিং রুটকে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি এই অঞ্চলে আরও সমন্বিত ও বাণিজ্য নেটওয়ার্ক জোরদারে একটি বড় পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন।
পাকিস্তানের হাইকমিশনার বলেন, এই সরাসরি রুটটি সরবরাহ শৃঙ্খলা আরও সহজ করবে এবং পণ্য পরিবহনে সময় কমাবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রায় ২ হাজার ৩০০টি (টুয়েন্টি ফিট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট বা ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কনটেইনার) ধারণক্ষমতার এই জাহাজটি বিভিন্ন ধরনের পণ্য বহন করে এনেছে। যা দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রতিফলন।গত আগস্টে বাংলাদেশে ছাত্রজনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি সমুদ্র সংযোগকে স্বাগত জানায়।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, শেখ হাসিনার পতনের পর ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য কার্যক্রম বাড়াতে আগ্রহী। আর তাদের আশা সরাসরি সামুদ্রিক পথের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়বে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ৮০০ মিলিয়ন ডলারেরও কম ছিল।
একটি সূত্র সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম ও মোংলা বাংলাদেশের প্রধান দুই বন্দর। গত পাঁচ দশকে এখানে পাকিস্তান জায়গা পায়নি। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হতো সিঙ্গাপুর ও কলম্বোর মাধ্যমে। কিন্তু এখন পাকিস্তানি জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে আসবে। আপনি বলতে পারবেন না পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রামে নিষিদ্ধ জিনিস (অস্ত্র) আসবে না। আর সেগুলো সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে যাবে না।’
২০০৪ সালের অস্ত্র উদ্ধারের উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ট্রলারে করে আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী দল উলফার জন্য ১ হাজার ৫০০ চাইনিজ অস্ত্র পাঠিয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর উলফার হাতে যাওয়ার আগেই জব্দ করা হয়।
টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের এ দুটি বন্দর থেকে চীনকে দূরে রেখেছিল।
ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সূত্র বলেছেন, ‘গত বছর মোংলা পোর্টের টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে চীনের ওপর একটি কৌশলগত জয় পেয়েছিল ভারত। কিন্তু এখন পাকিস্তান চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে। এই বিষয়টি অবশ্যই এই অঞ্চলের ভূরাজনীতির ওপর প্রভাব ফেলবে। কারণ মিয়ানমারও চট্টগ্রামের খুব কাছে।’
টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া বলছে, মিয়ানমারে এখন টালমাটাল অবস্থা। ভারতের শঙ্কা মিয়ানমার থেকে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং মাদক কারবারি বেড়ে যেতে পারে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সরকারি কোনো সূত্রের কোনো বক্তব্য প্রকাশ করা হয়নি। যদিও দুই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটিকে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইন্ডিপেনডেন্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বন্দরে পাকিস্তানি কার্গো জাহাজের নোঙর করার বিষয়টি ঐতিহাসিক পরিবর্তনের প্রতীক। এটি পাকিস্তান-বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত জটিল কূটনৈতিক সম্পর্কে উষ্ণতার নতুন দিগন্তের সূচনা করছে। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে এই উষ্ণতার সূচনা হয়েছে।
১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান ঘটে। নয় মাসব্যাপী এই সংঘাতে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ঘটে। যা ঢাকা ও ইসলামাবাদের সম্পর্ককে দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবিত করেছে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। সর্বশেষ, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর তিনি ভারতে চলে। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শেখ মুজিবের ছবি ও ভাস্কর্য অপসারণ করা হয়।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পর ইসলামাবাদ ও ঢাকা উভয়ই সম্পর্কে উষ্ণতা আনা এবং স্বাভাবিকীকরণে আগ্রহ প্রকাশ করে। গত সেপ্টেম্বরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকের ফাঁকে সাক্ষাৎ করেন। যেখানে তারা দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা পুনরায় চালু করার আহ্বান জানান।