কমলাপুর ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোতে (আইসিডি) দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা প্রায় ৫০০ কনটেইনারের হিসাব মিলছে না। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এসব চালানের আগামপত্র (বিল অব এন্ট্রি) দাখিল হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তে নামে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এতে বেরিয়ে এসেছে ভয়াবহ তথ্য। উচ্চ শুল্কের কসমেটিকস থেকে এলইডি লাইটসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য ছিল বলে ধারণা গোয়েন্দাদের। তারা বলছেন, কর ফাঁকি দিতে এসব কনটেইনারের বড় অংশ গোপনে খালাস করা হয়েছে। এরই মধ্যে কাস্টম হাউস আইসিডি কমলাপুরের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির তদন্তেও মিলছে না পূর্ণ হিসাব। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, কাস্টম হাউস আইসিডি কমলাপুরের দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা অনেক কনটেইনারের বিল অব এন্ট্রি দাখিল না হওয়ায় তদন্তে নামে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ৪৯৫টি বিল অব এন্ট্রি কাস্টমসের কেন্দ্রীয় সার্ভার অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডে (আমদানি-রপ্তানির শুল্ক ব্যবস্থাপনার সফটওয়্যার) দাখিল করা হয়নি। সাধারণত একটি কনটেইনারে একটি বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হয়। এতে পরিষ্কার যে, গত সাত বছরে ৪৯৫টি কনটেইনারের হিসাব মিলছে না। প্রশ্ন উঠেছে, আমদানি করা এসব পণ্য তাহলে গেল কোথায়। এই পণ্যের খোঁজে কাস্টম হাউস আইসিডি কমলাপুরের কমিশনার ও বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় শুল্ক গোয়েন্দা। আর শুল্ক গোয়েন্দার চিঠি পেয়ে যৌথভাবে কাজ শুরু করে কাস্টমস ও বন্দর কর্তৃপক্ষ। তাতেও কোনো সুরাহা মিলছে না। এসব কনটেইনারের একটি বড় অংশ গোপনে খালাস হয়েছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শুল্ক কর্মকর্তারা। উচ্চ শুল্কের এসব পণ্যে শত শত কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করছেন তারা।
জানতে চাইলে কাস্টম হাউস কমলাপুরের কমিশনার নাহিদা ফরিদী বলেন, ২০১৫ সালের বেশ কিছু পুরোনো বিল অব এন্ট্রি জমা হয়নি, এমন কিছু কনটেইনার মিসিং রয়েছে। অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম ও বন্দরের তথ্যের মধ্যে বেশকিছু গরমিল পাওয়া গেছে। যে কারণে আমরা একটি টিম গঠন করে দিয়েছি। এই টিম সামঞ্জস্য বিধানের (রিকনসিলেশন) কাজ করছে। তবে কনটেইনার মিসিংয়ের সঠিক হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। বেশিরভাগ কনটেইনার ১০ থেকে ১২ বছর আগের। তিনি বলেন, খোঁজ না মিললে শিপিং এজেন্টদের তলব করা হবে। তারা ভালো বলতে পারবেন এসব কনটেইনারে কী ধরনের পণ্য ছিল।
কমলাপুর কাস্টম হাউস সূত্রে জানা গেছে, কমলাপুর আইসিডিতে এসব কনটেইনারের মধ্যে মাত্র ৩৬টি শনাক্ত করা গেছে। কিছু কনটেইনার পুনঃরপ্তানি হয়েছে। আর কিছু পণ্য নিলাম করা হয়েছে। পুনঃরপ্তানি নিশ্চিত হতে শিপিং এজেন্টের কাছে তথ্য চাওয়া হবে। তবে শুল্ক কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব কনটেইনার পুনঃরপ্তানি বা নিলাম হয়েছে, সেসব কনটেইনার তো আমদানি হয়েছে। আর আমদানির তথ্য এরই মধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে চাওয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার কমলাপুর কাস্টম হাউসে গঠিত টিম এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও, কমিটি সেটি দিতে পারেনি। কনটেইনারে কী ধরনের পণ্য ছিল, সাত সদস্যের কমিটি এ বিষয়েও তদন্ত করছে বলে নিশ্চিত করেছে আইসিডি সূত্র।
সূত্র আরও জানায়, তিন বছর ধরে বিষয়টি চিঠি চালাচালির মধ্যে আটকে থাকে। এবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে বিষয়টি। সর্বশেষ গত ২৮ অক্টোবর এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি ইস্যু করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে আইসিডি কমলাপুরে আসা পণ্য চালান যথাযথ নিয়মে খালাস হয়েছে কি না; খালাস না হলে নিলামের ব্যবস্থা করা হয়েছে কি না, চিঠিতে তার হালনাগাদ তথ্যও জানতে চেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। আর নিলাম না হয়ে থাকলে নিলামের বিড মূল্যসহ প্রতিটি বিল অব এন্ট্রিভিত্তিক তথ্য সাত কর্মদিবসের মধ্যে ছক আকারে পাঠাতে বলা হয়েছে। ১৪ পৃষ্ঠার এই চিঠিতে প্রতিটি বিল অব এন্ট্রির তথ্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২৩ দিনের বেশি সময় পার হলেও কোনো কার্যকর ফল আসেনি। বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, বন্দরের কনটেইনারগুলোর হিসাব ম্যানুয়াল হওয়ায় বেশি সময় লাগছে।
এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন, কনটেইনারগুলোর বিল অব এন্ট্রি দাখিল না হওয়ায় আসলে কী ধরনের পণ্য ছিল, তা নির্ধারণ করা ছিল না। আইসিডি থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি কাজ করছে। কমিটির প্রতিবেদন পেলে প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে।
কমলাপুর আইসিডির অন্য একটি সূত্র জানায়, আইসিডি কমলাপুরের তদন্ত করলে আরও অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে। ওই সূত্র বলছে, ২০১৫ সালের কনটেইনার ছাড়া আরও অনেক পুরোনো কনটেইনারের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১০ সালেরও অনেক কনটেইনার মিসিং রয়েছে। আইসিডিতে পড়ে থাকা এমন অনেক কনটেইনার রয়েছে, যেগুলো বছরের পর বছর ধরে কাস্টম হাউসে পড়ে আছে। যার প্রকৃত মালিকও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে বিষয়টি নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ তৎপর হলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ সেভাবে আমলে নেয়নি।
শুল্ক গোয়েন্দার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিল অব এন্ট্রি জমা না হওয়া এসব কনটেইনারে এলইডি লাইট, বডি স্প্রে এবং কারখানার কাঁচামাল আমদানি করা হয়। উচ্চ শুল্কের এসব পণ্য রাজস্ব ফাঁকি দিতে গোপনে খালাস করে নিয়েছে বলেও আশঙ্কা করছেন শুল্ক গোয়েন্দার কর্মকর্তারা।
আইসিডি কমলাপুরে বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা হিসেবে পদস্থ রয়েছেন ডেপুটি ট্রাফিক ম্যানেজার আশরাফ করিম চৌধুরী। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে তাকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।