বাংলাদেশে ধরা পড়া ইলিশের বড় সুসময় ধরা হয় ২০১৯ সালকে। ওই বছর দেশে সবচেয়ে বড় আকৃতির ইলিশ ধরা পড়েছিল। বর্ষা মৌসুমে ধরা পড়া ইলিশের গড়পড়তা ওজন প্রায় এক কেজি। এর পরের তিন বছর টানা ইলিশের গড় ওজন কমেছে, আকৃতি ছোট হয়েছে। সেই সঙ্গে দামও বেড়েছে। ওই সময়ে ইলিশের গড় ওজন ২০০ গ্রাম কমেছে।
বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণে এই চিত্র উঠে এসেছে। তবে মৎস্য অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পর্যবেক্ষণে, এ বছরের জুলাইয়ে এ পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। চলতি মাসের শুরু থেকে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায় ধরা পড়া ইলিশের বেশির ভাগই বড় আকৃতির। একেকটির ওজন কমপক্ষে এক কেজি।
সংস্থা দুটি বলছে, এক সপ্তাহ ধরে বঙ্গোপসাগর থেকে নদ-নদীতে ইলিশ আসা তো বেড়েছেই; এমনকি জোয়ারের সঙ্গে আসা ইলিশ পুকুরেও ঠাঁই নিচ্ছে। সম্প্রতি দেশের চারটি জেলার পুকুরে ইলিশ ধরেছেন জেলেরা।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাঁদপুর কেন্দ্র এক সপ্তাহ ধরে দেশের ১৫টি স্থানে ধরা পড়া ইলিশের ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। তাতে ইলিশের ওজন আবারও বাড়তে শুরু করেছে বলে দেখা গেছে। প্রায় এক হাজার ইলিশ ওজন করে সংস্থাটির বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ধরা পড়া ৭০ শতাংশ ইলিশের ওজন ৯০০ থেকে ১ কেজি ২০০ গ্রাম। এসব ইলিশ দু-এক দিনের মধ্যে বাজারে আসতে শুরু করবে। ফলে তিন বছর ধরে চলা ছোট আকৃতির ইলিশের খরা কাটতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন তাঁরা।
এ ব্যাপারে মৎস্য অধিদপ্তরের উপপ্রধান ও ইলিশ শাখার প্রধান মাসুদ আরা বলেন, সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগের কারণে গত এক যুগে দেশে ইলিশের উৎপাদন ও ওজন বেড়েছে। তবে দু-তিন বছর ধরে বৃষ্টি কম হওয়াসহ নানা প্রাকৃতিক এবং আবহাওয়াগত কারণে ইলিশ কম পাওয়া গেছে। সামগ্রিকভাবে গড়ে ইলিশের ওজন ৭২০ গ্রামে নেমে আসে। তবে এ বছর আবারও বড় ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।
মৎস্যবিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে আহরিত কোনো মাছের প্রজাতি আহরণ কমে যায় মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, ওই মাছের জন্য অনুকূল প্রতিবেশ ব্যবস্থা যদি না থাকে। অর্থাৎ নদী ও সাগরে ইলিশের জন্য প্রয়োজনীয় পানির সরবরাহ, দূষণ কম থাকা ও প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের সরবরাহ না থাকা। দ্বিতীয়ত, আবহাওয়াগত কারণে বৃষ্টিপাত কমে গেলে ইলিশ গভীর সাগরে চলে যায়। নদী ও উপকূলের কাছাকাছি আসা কমিয়ে দেয়। এতে বড় ইলিশ ধরা কম পড়ে। ইলিশের সংখ্যাও কমে যায়।
মৎস্য অধিদপ্তর থেকে গত তিন বছরে ইলিশের আকৃতি ছোট হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বৃষ্টি কমে যাওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বঙ্গোপসাগর থেকে মেঘনার মোহনা দিয়ে ইলিশের প্রবেশ মুখগুলোতে ডুবোচরের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ইলিশ আসার পথ আটকে যাওয়ায় নদীতে আগের চেয়ে কম ইলিশ ধরা পড়ছে। বিশেষ করে বড় ইলিশগুলো উপকূলের কাছাকাছি ও নদীতে আসা কমিয়ে দিয়েছে বলে সংস্থাটির বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
মৎস্য বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সাধারণত দেশে জুন-জুলাই মাসে মৌসুমি বায়ু আসার পর অর্থাৎ বর্ষা শুরু হলে ইলিশ বাড়তে থাকে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে জুলাই-আগস্ট মাসে বেশি ইলিশ ধরা পড়ছে। এমনকি সেপ্টেম্বরেও বড় ইলিশ ধরা পড়ছে। আর ২৩ জুলাই পর্যন্ত সমুদ্রে সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ থাকে। ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন বাড়াতে এবং প্রজননের জন্য সময় দিতে সরকার থেকে ওই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার সময় শেষ হওয়ার পর ইলিশ বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের জরিপে দেখা গেছে, এ বছর সমুদ্রে আগের চেয়ে বেশি ইলিশ দেখা গেছে। এখন এসব ইলিশ দেশের বিভিন্ন নদ-নদীতে আসতে শুরু করেছে। সাধারণত নদীর চেয়ে সাগরের ইলিশের ওজন বেশি ও আকৃতি বড় হয়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাঁদপুর কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, এটা ঠিক কয়েক বছর ধরে বড় ইলিশ কম পাওয়া যাচ্ছিল। সমুদ্রে মৎস্যসম্পদ আহরণে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার ফলাফল হিসেবে ইলিশসহ সব ধরনের মাছের উৎপাদন এবং ওজন এবার বাড়বে।
মৎস্যসম্পদবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ থেকে ২০২০ সালে বাংলাদেশে ইলিশের ওজন ও আকৃতি বিষয়ে একটি গবেষণা জরিপ প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ধরা পড়া ইলিশের গড় ওজন ছিল ৫৩৫ গ্রাম। ২০১৯ সালে তা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ৯১৫ গ্রাম হয়। গত বছর তা কমে ৭২০ গ্রাম হয়েছে। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা সামান্য বেড়ে ৫ লাখ ৭১ হাজার টন হয়েছে।