অফিসের তাপমাত্রা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা সহজ কথায় এসি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং যেখানে নারী ও পুরুষ একসাথে কাজ করেন, সেখানে এসি বন্ধ আর ছেড়ে দেওয়া নিয়ে নীরব যুদ্ধ যেন বেশ সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক্ষেত্রে ইউএস অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন একটি মানদণ্ড ঠিক করে দিয়েছে। সংস্থাটির সুপারিশ হলো অফিস প্রধান এসির তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে পারেন।
তবে, ২০১৫ সালে নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক সমীক্ষা অনুসারে, অফিস ভবনের ভেতরে তাপমাত্রা সেট করা হয়েছে ‘১৯৬০ এর দশকে তৈরি করা থার্মাল কম্ফোর্ট মডেল অনুযায়ী’।
এই হিমহিম ঠান্ডা নিয়ে যতই আলোচনা থাকুক, অতিরিক্ত ঠান্ডা পরিবেশ যে অস্বস্তি তৈরি করতে পারে তা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক অফিসের তাপমাত্রা কাজের উৎপাদনশীলতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে নারীদের কাজে।
অফিসে এসির তাপমাত্রা যত বাড়ানো হবে অর্থাৎ ঠান্ডা যত কম হবে নারীদের কাজ করার সক্ষমতা তত বাড়বে।
ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ও বার্লিন সোশ্যাল সায়েন্স সেন্টারের এক নতুন যৌথ গবেষণায় এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, তাপমাত্রা বেশি হলে নারীরা গাণিতিক এবং কথা বলার মতো কাজগুলোয় আরও ভালো পারফর্ম করেন। কিন্তু তাপমাত্রা যখন কম থাকে তখন পুরুষদের পারফর্মেন্স ভালো হচ্ছে।
“অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে নারীরা পুরুষদের তুলনায় ঘরের ভেতরে বা যেকোনও আবদ্ধ পরিবেশে বেশি তাপমাত্রা পছন্দ করেন, কিন্তু এর সাথে যে তাদের কাজের উৎপাদনশীলতাও জড়িত, সে ব্যাপারে কেউ কথা বলেনি।”
“”আমরাই প্রথম দেখিয়েছি যে তাপমাত্রা কমানো/বাড়ানো নিয়ে যুদ্ধ কেবল আরামের জন্য নয়।” গবেষক বার্লিন সোশ্যাল সায়েন্সেস সেন্টার এবং গবেষণা প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক ডঃ অ্যাগনে কাজাকাইট বিবিসিকে এসব কথা বলেছেন।
সংক্ষেপে, এই সমীক্ষার মাধ্যমে জানা গিয়েছে যে লিঙ্গভেদে ভিন্ন ভিন্ন তাপমাত্রার এই প্রভাব কেবলমাত্র আরামের উপর নির্ভর করে না। বরং এর সাথে তাদের উৎপাদনশীলতা আর বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মক্ষমতাও প্রভাবিত হয়।
একেক সময় তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস করা হয়।
প্রতিটি সেশনে, অংশগ্রহণকারীদের একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তিনটি ভিন্ন মৌখিক এবং গণিতের কাজ সম্পন্ন করতে হয়েছিল।
কক্ষের তাপমাত্রা এবং মৌখিক ও গাণিতিক কাজগুলোয় অংশগ্রহণকারীদের স্কোরের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়।
তবে কগনিটিভ রিফ্লেকশন টেস্ট অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক পরীক্ষায় পুরুষ ও নারীদের মধ্যে এই তাপমাত্রার তারতম্য কোনও প্রভাব ফেলেনি।
“পুরুষরা কম তাপমাত্রায় সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল এবং নারীরা উচ্চ তাপমাত্রায় উল্লেখযোগ্যভাবে ভালো পারফর্ম করেছে, যেখানে পুরুষ অংশগ্রহণকারীরা সামান্য খারাপ পারফর্ম করেছে,” গবেষক কাজাকাইট ব্যাখ্যা করেন।
তার সহকর্মী টম চ্যাং, সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, অফিসে তাপমাত্রা আরামের বাইরে দৈনন্দিন কাজের উপর প্রভাব ফেলতে পারে কিনা তা বিবেচনা করে এই গবেষণাটি পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
“এই গবেষণাটি এত মনোযোগ পেয়েছে কারণ মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে অফিসে তাপমাত্রা বাড়ানো কমানো নিয়ে যে যুদ্ধ রয়েছে সেটা সমন্বয় করা প্রয়োজন,” তিনি বলেছেন।
এই গবেষণার ফলাফলে অফিসে তাপমাত্রার বাড়ানো কমানোর ঝুঁকিগুলোও তুলে ধরা হয়েছে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন।
তাদের পরামর্শ যেসব কর্মক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীরা সহাবস্থান করেন, তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে অফিসের ভেতরের তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি হওয়া উচিত।
“ম্যানেজারদের উচিত অফিসে তাপমাত্রার দিকে আরও মনোযোগ দেওয়া।
কর্মীরা কী বলেন সেটা শোনা এবং তাদের অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত, কারণ এটি তাদের উৎপাদনশীলতার উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে,” বলেছেন কাজাকাইট।
এটি নিছক কোনও কাকতালীয় বিষয় নয়। দুইজন গবেষকদের মতে, সমস্যা হলো যে বেশিরভাগ অফিসগুলো ৬০ এর দশকের একটি পুরনো সূত্র অনুসারে চলে।
ওই সূত্র অনুযায়ী তাপমাত্রা সেট করার ক্ষেত্রে তারা মূলত কর্মীদের মেটাবোলিজম রেট বা হজমশক্তিকে একটি রেফারেন্স পয়েন্ট হিসাবে নেয়।
আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, ৪০ বছর বয়সী এবং প্রায় ৭০ কিলো ওজনের একজন ব্যক্তির
শরীরে খাবার হজম করতে যে তাপ উৎপাদনের প্রয়োজন এই সূচকটি দিয়ে সেটি গণনা করা হয়েছে।
কিন্তু নারীদের মেটাবোলিজম সাধারণত পুরুষদের তুলনায় ধীরগতির হয়, এর মানে হলো তাদের কম তাপ হারাতে হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সামান্য উষ্ণ পরিবেশ প্রয়োজন।
কিংমা, নেদারল্যান্ডসের মাস্ট্রিচ ইউনিভার্সিটির একজন বায়োফিজিসিস্ট এবং ন্যাচারাল ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার সহ-লেখক।
এমন পার্থক্য হওয়ার আরেকটি মূল কারণ নারীদের গঠন পুরুষদের তুলনায় কিছুটা ছোট হয় এবং তাদের শরীরের চর্বি বেশি থাকে, যার কারণে খাবার হজমের শক্তি আসে চর্বি থেকে।
চর্বি থেকে যে শক্তি আসে সেটি পেশী থেকে আসা শক্তির তুলনায় ধীরে কাজ করে।
এ কারণে নারীদের শরীরে হজম প্রক্রিয়ায় তাপ কম উৎপন্ন হয়। তাই তাদের বেশি ঠান্ডার প্রয়োজন নেই।
বর্তমান সূত্রটি অর্ধ শতাব্দী আগের শ্রমশক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে বেশিরভাগ পুরুষদের নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক এই সমীক্ষা বলছে, ” বিশ্রামের সময় নারীদের তাপ উৎপাদন ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে”।
আরেকটি বিষয় যা গবেষণায় উঠে আসেনি, সেটা হলো নারীরা সাধারণত আরামদায়ক ঢিলেঢালা পোশাক পরেন যা নারীদের ঠান্ডা লাগার একটি বড় কারণ কিন্তু অনেক অফিসে পুরুষদের স্যুট টাই পরে থাকতে হয়।
এসির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের যুদ্ধে নারীদের চ্যালেঞ্জের সাথে একমত হয়েছেন গবেষকরা।
তাদের গবেষণায়, অফিসে এসির তাপমাত্রা আরামদায়ক রাখার ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য কমানোর পাশাপাশি বিশ্ব উষ্ণায়ন মোকাবিলায় কম শক্তি ব্যয়ের কথা মাথায় রেখেও গ্রীষ্মকালে অফিসগুলোকে কিছুটা উষ্ণ তাপমাত্রায় রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
সেইসাথে, গবেষকরা শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপের অন্যান্য মানদণ্ড এই মডেলে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
উদাহরণস্বরূপ, শরীরের ওজন এবং বয়সের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা অনুভবে হেরফের হয়।
স্থূল মানুষদের গরম লাগার প্রবণতা বেশি আবার বয়স্ক ব্যক্তিদের হজম প্রক্রিয়া খুব ধীরগতিতে হয়।
এক্ষেত্রে কীভাবে নারী পুরুষের আরামদায়ক তাপমাত্রায় সামঞ্জস্য আনা যায় সেটি ভাবতে হবে।
তবে গবেষক কিংমার মতে, এর সমাধান খুব সহজ, “গ্রীষ্মে ভবনটি কম ঠান্ডা করা যায় এবং যারা গরম অনুভব করেন তারা তাদের পোশাক পরিবর্তন করতে পারেন,” বিবিসিকে তিনি ব্যাখ্যা করেন।
“অথবা কিছু নির্দিষ্ট এলাকা ঠান্ডা করা যেতে পারে যে স্থান ঠান্ডা রাখা প্রয়োজন বলে মনে করা হয়,” তিনি যোগ করেন।
কে কোন তাপমাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন সেটার নিখুঁত কোনও হিসেব নেই। কোনও একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সবাইকে একমত করা সম্ভব না।
কারও খুব ঠান্ডা লাগতে পারেন, ওই একই মাত্রায় অনেকের আবার গরম লাগতে পারে।
অফিসে এসির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনায় সাম্প্রতিক এই গবেষণা সাহায্য করতে পারে।
ওই গবেষণায় স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ একটি আদর্শ তাপমাত্রার কথা বলা হয়েছে।
ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি আন্তর্জাতিক দল, ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়, অথবা ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলাম্বিয়া আদর্শ তাপমাত্রা কী তা নির্ধারণ করার সাহস করেছে, যা মানুষের জন্য স্বস্তিদায়ক হয়েছে।
গবেষণা অনুসারে, আমরা কেমন তাপমাত্রায় থাকি সেটি আমাদের মেজাজকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে।
গবেষণা দলটি যাচাই করে দেখেছে যে, দিনের বেলায় যদি অফিস বা যেকোনও আবদ্ধ স্থানের ভেতরের তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে না নামে এবং ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপর না ওঠে তাহলে সেই তাপমাত্রাকে স্বাচ্ছন্দপূর্ণ বলা যেতে পারে।
এই সীমার বাইরে গেলেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
তাপমাত্রার ক্ষেত্রে যদি একটি মাত্র নিখুঁত পরিমাপ বেছে নিতে বলা হয়, সেক্ষেত্রে তা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন।
রাতে অবশ্য দৃশ্যপট বদলে যায়, যেখানে দিনের সর্বাধিক তাপমাত্রার সাথে রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য প্রায় ১৫ ডিগ্রি হওয়াই মানুষের পছন্দ বলে মনে করা হয়। সেই হিসাবে, যদি আমরা দিনের জন্য সর্বোচ্চ ২৫ ডিগ্রীকে রেফারেন্স হিসাবে নিই, একটি “স্বাচ্ছন্দময়” রাতের জন্য, আবহাওয়াগতভাবে বলতে গেলে, তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি হওয়া দরকার। গবেষকরা উচ্চ তাপমাত্রার সাথে ঘুমের সমস্যার যোগও পেয়েছেন।