দলীয় প্রতীকে ভোটের ক্ষেত্রে কেন্দ্র থেকে প্রার্থী ঠিক করে দেওয়া হতো। এতে সংসদ সদস্যদের এতটা প্রভাব ছিল না। এ ছাড়া প্রচার-প্রচারণায় সংসদ সদস্যদের নিষেধাজ্ঞা থাকায় উপজেলা নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রভাব অনেকটা কমে গিয়েছিল। এবার প্রতীক না দেওয়ার কারণে উপজেলা ভোটে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী শক্তিতে পরিণত হয়েছেন বলে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে বলছেন।
সব মিলিয়ে তৃণমূলের দ্বন্দ্ব কমার চেয়ে বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতা।
এমন পটভূমিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বারবার প্রভাব বিস্তার না করার নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু তা কানে তুলছেন না মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা।
দলটির সূত্রগুলো বলছে, পরিস্থিতি সামলাতে শেষমেশ প্রশাসনকে কাজে লাগানো হতে পারে। বিশেষ করে কোথাও সংঘাতের আশঙ্কা থাকলে প্রশাসনকে কড়া অবস্থান নেওয়ার বার্তা দেওয়া হবে।
এবার এখন পর্যন্ত ১৪টি উপজেলায় একজন প্রতিমন্ত্রী ও ১২ সংসদ সদস্যের নিকটাত্মীয়রা প্রার্থী হচ্ছেন। অন্যদিকে সংসদ সদস্যদের বিরোধী পক্ষগুলো নিজেদের প্রার্থী নিয়ে ভোটে আছেন। সব মিলিয়ে তৃণমূলের দ্বন্দ্ব কমার চেয়ে বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতা।
টপ।
কেউ যদি দলের মধ্যে নিজের দল ভারী করার চেষ্টা করেন, তাতে লাভ হবে না। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। কেউ শান্তি বিনষ্টের চেষ্টা করলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম
এবারের ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হবে চার ধাপে। প্রথম ধাপে আগামী ৮ মে ১৫২টি উপজেলায় এবং দ্বিতীয় ধাপে ২১ মে ১৬১টি উপজেলায় ভোট হবে। আগে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন ছিল নির্দলীয়। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
গত ৩০ মার্চ রংপুর বিভাগ, ৩১ মার্চ চট্টগ্রাম এবং ৪ এপ্রিল খুলনা বিভাগের জেলাগুলোর নেতা এবং সংসদ সদস্যদের নিয়ে ঢাকায় বৈঠক করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। এই তিন বিভাগের তৃণমূলের নেতাদের একটা বড় অংশই স্থানীয় সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করেন। বিশেষ করে উপজেলা নির্বাচনে সংসদ সদস্যরা নিজেদের স্বজন ও অনুগতদের প্রার্থী করার বিরোধিতা করেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, কেউ যদি দলের মধ্যে নিজের দল ভারী করার চেষ্টা করেন, তাতে লাভ হবে না। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। কেউ শান্তি বিনষ্টের চেষ্টা করলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বাড়ি নোয়াখালী। তাঁর জেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী বয়সে ওবায়দুল কাদেরের চেয়েও জ্যেষ্ঠ। তিনি সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদের পরপর তিনবারের চেয়ারম্যান। এবারও তিনি চেয়ারম্যান পদে বিনা বাধায় নির্বাচনী বিতরণী পার হবেন আশা করেছিলেন। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী এই উপজেলায় তাঁর ছেলে আতাহার ইশরাক শাবাব চৌধুরীকে প্রার্থী করেছেন।
খায়রুল আনম চৌধুরী গত মাসের শেষের দিকে গণভবনে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নালিশ করে গেছেন। আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘সংসদ সদস্য একরাম চৌধুরীর ছেলে বয়সে তরুণ। তাঁর সঙ্গে প্রার্থী না করলেও হতো।’
টাঙ্গাইল-১ (ধনবাড়ী-মধুপুর) আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মো. আব্দুর রাজ্জাক তাঁর নির্বাচনী এলাকার দুই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে দুজন প্রার্থী মনোনীত করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত শনিবার টাঙ্গাইলের মধুপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উপজেলার শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা না করে সেখানে দলের প্রার্থী ঘোষণা করায় আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছেন। আরও কয়েকটি জায়গা থেকেও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে এ ধরনের অভিযোগের চিঠি এসেছে।
জানা গেছে, ৩১ মার্চ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ১০ উপজেলার সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা না করেই প্রার্থী ঘোষণা করেন। জেলার বাকি পাঁচ আসনের সংসদ সদস্য ও তৃণমূল নেতারা এতে ক্ষুব্ধ।
মাদারীপুর জেলায় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা দলের দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে ঘিরে বিভক্ত। এক পক্ষে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান। অন্যপক্ষে কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। উপজেলার ভোটেও এর প্রভাব পড়েছে। মাদারীপুর সদর উপজেলায় নিজের ছেলে মো. আসিবুর রহমান খানকে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন শাজাহান খান। অন্যদিকে শাজাহান খানের চাচাতো ভাই ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান পাভেলুর রহমান খান সমর্থন পাচ্ছেন বাহাউদ্দিন নাছিম সমর্থকদের।
প্রতীক বরাদ্দ না দিলে তৃণমূলের বিভেদ কমবে, এমন কৌশল ছিল আওয়ামী লীগের। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল না-ও হতে পারে। কারণ, তৃণমূলের দ্বন্দ্ব আরও ছড়িয়েছে।