১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়ন চলছে। শুরুটা জাতিসংঘে যুক্ত হওয়া নিয়ে। সবেমাত্র ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়া পাকিস্তান ওই বছরের ৩০সেপ্টেম্বর নতুন সদস্য হিসেবে জাতিসংঘে যুক্ত হতে গিয়ে শুধুমাত্র আফগানিস্তানের আপত্তির মুখে পড়তে হয়। পাকিস্তান জাতিসংঘে যুক্ত হলেও ভোট না দিয়ে একমাত্র বিরোধিতা করে আফগানিস্তান।
১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ নির্ধারিত আফগানিস্তানের ‘ডুরাল্ড লাইন’ সীমানা নিয়ে শুরু হয় নতুন বিতর্ক। সেই সীমানা সব সময়ই অবৈধ বলে বিবেচনা করে আসছে আফগানিস্তান। এ নিয়ে কয়েকবার সংঘর্ষেও জড়িয়েছে দুই দেশ।
চলমান এই সীমান্ত বিরোধের পাশাপাশি শরণার্থী সংকট, উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর কার্যক্রম এবং কূটনৈতিক টানাপোড়েন- সবমিলিয়ে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে টানাপড়েন লেগেই আছে। এরমধ্যে ১৯৭০-এর দশক থেকে সোভিয়েত আগ্রাসন, গৃহযুদ্ধ, তালেবান উত্থান ও সন্ত্রাসবাদ এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে।
দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ শত্রুতা শুরু হয় ২০০৭ সালের মাঝামাঝিতে, যখন তাহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহার করে পাকিস্তানে হামলা চালায়। টিটিপি মূলত পাকিস্তানি তালেবান নামে পরিচিত। সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটি আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে সক্রিয় রয়েছে। পাকিস্তানি তালেবান নেতারা প্রকাশ্যে আফগান তালেবানের প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে, বরাবরই এই দাবি অস্বীকার করেছে আফগানিস্তান।
সম্পর্ক যদিও সব সময় এক জায়গায় আটকে থাকেনি। উত্থান-পতনও হয়েছে। মূলত, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আল কায়েদার আত্মঘাতী হামলার হামলার পর আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে আগ্রাসন শুরু করে আমেরিকা। যেটি পাকিস্তানসহ এই অঞ্চলের নেতাদের পছন্দ হয়নি। এরপর ২০২১ সালে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবান যখন আবারও আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করে তখন পাকিস্তান-আফগান সম্পর্কে নতুন রূপ নেয়। তালেবানের ক্ষমতা দখলে সবচেয়ে বেশি উল্লসিত ছিল পাকিস্তানের বিভিন্ন সামরিক সংস্থা। এটা যেন তাদের বিজয় ছিল। অথচ, ৩ বছর পেরোনোর আগেই পরিস্থিতি আমূল পাল্টে গেছে।
বিশেষ করে, ২০২৪ সাল ছিল পাকিস্তানের জন্য গত এক দশকের মধ্যে অন্যতম রক্তক্ষয়ী বছর। এ বছরে পাকিস্তানজুড়ে বিভিন্ন সহিংসতায় কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এসব সহিংসতার পেছনে টিটিপিকে দায়ী করছে পাকিস্তান, যারা আফগানিস্তানের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।
এমন অবস্থায় পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার কাবুল সফর করেন। এতে কূটনৈতিক সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি ঘটলেও চলতি বছরের শুরু থেকে সহিংসতা আরও বাড়তে থাকে। পিআইসিএসএস তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে সহিংসতার মাত্রা প্রায় পুরো ২০২৪ সালের মোট সহিংসতার সমান।
দুই দেশের সম্পর্কে চরম টানাপড়েনের মধ্যে পাকিস্তানের ‘চিরশত্রু’ ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্ক ক্রমশ উন্নতির দিকে মোড় নিচ্ছিল। গত ৯ অক্টোবর ভারত সফরে যান আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি। শুধু তাই নয়, বর্তমানে ভারতের একটি ছোট প্রতিনিধিদলও কাবুলে অবস্থান করছে।
আমির খান মুত্তাকির এ সফর এমন সময়ে হচ্ছে, যখন ভারত–পাকিস্তান সম্পর্ক যেমন খারাপ হচ্ছে, তেমন পাকিস্তান ও তালেবান সম্পর্কও দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে।
এমন অবস্থায় সন্ত্রাসী সংগঠন টিটিপির প্রধান নেতাকে লক্ষ্য গত ১০ অক্টোবর রাতে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে বিমান হামলা চালায় পাকিস্তানের বিমানবাহিনী। এই হামলার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানান ভারত সফররত আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকিও।
তিনি বলেন, ‘আফগানদের ধৈর্য পরীক্ষা করো না। যদি করো তাহলে ব্রিটিশ, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোকে জিজ্ঞাসা করো আফগানিস্তানের সঙ্গে খেলার পরিণতি কী হয়।’ তার এমন বক্তব্যের একদিন না যেতেই শনিবার রাতে পাকিস্তান বাহিনীকে লক্ষ্য করে সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় গুলিবর্ষণ করে আফগান বাহিনী। পাক সেনাদের পাল্টা আক্রমণে দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয়, যা চলে রাতভর।
পাক নিরাপত্তা সূত্রের বরাতে জিও নিউজ জানিয়েছে, আঙ্গুর আড্ডা, বাজাউর এবং কুর্রামসহ বেশ কয়েকটি সীমান্ত পয়েন্টে বিনা উসকানিতে গুলিবর্ষণ শুরু করে আফগানিস্তান। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার প্রতিক্রিয়ায় কামান, ট্যাঙ্ক এবং হালকা ও ভারী উভয় অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এতে বেশ কয়েকটি আফগান পোস্ট ধ্বংস এবং ‘সেনা ও সন্ত্রাসীদের’ ব্যাপক ক্ষতি করা হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দাবি, তারা ডুরান মেলা, তুর্কমানজাই, শহিদান, কুনার, চাগাইসহ সীমান্তের ১৯টি আফগান পোস্ট দখল করেছে। একইসঙ্গে সঙ্গে সংঘাতের সময় এসব পোস্টে কয়েক ডজন আফগান সেনা নিহত এবং আহত হয়েছেন। তাদেরকে ফেলে রেখেই কর্মকর্তা ও সদস্যরা পালিয়েছেন।
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নাকভি বলেছিলেন, বেসামরিক লোকজনের ওপর আফগান বাহিনীর গোলাবর্ষণ আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন। পাকিস্তানের সাহসী বাহিনীর তাৎক্ষণিক ও কার্যকর জবাব এই বার্তাই দেয় যে, কোনো উসকানি সহ্য করা হবে না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানি বাহিনী তৎপর রয়েছে এবং আফগানিস্তানকে ইটের বদলে পাথর দিয়ে জবাব দেওয়া হচ্ছে। পাকিস্তানের জনগণ দেশের সেনাবাহিনীর পাশেই আছে। আফগানিস্তানকেও ভারতের মতোই উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তান ও তালেবানের মধ্যে প্রতিশোধমূলক এই হামলা পরিস্থিতিকে ভয়াবহের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তবে, তালেবান সরাসরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবিলায় সক্ষম নয়। কিন্তু, তৃতীয় পক্ষের উস্কানিতে যদি তারা সংঘাতে জড়ায় তাহলে চলমান সংঘাত যুদ্ধে গড়াতে পারে।