রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইপ্রেমী ও সংস্কৃতিসেবীদের মাসব্যাপী প্রাণের প্রদীপ জ্বালানোর সব আয়োজন সম্পন্ন। উৎসব শুরু হবে আজ শনিবার থেকে। এদিন অমর একুশে বইমেলা ২০২৫-এর উদ্বোধন করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। একদিন মাত্র ৩২টি বই দিয়ে শুরু হওয়া এ মেলা অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে সুবিশাল পরিসর নিয়ে আজ বাংলাদেশের ঐতিহ্যের অংশে পরিণত। আজ পাঠক-অপাঠক সব বাংলাদেশির প্রাণের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা পড়ে গেছে অমর একুশে বইমেলা।
মানব সভ্যতার চেতনা সম্পদের বাহক বই; সেই বই ও মেলার ধারণার মেলবন্ধন ঘটার পর থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে বই নিয়ে আয়োজিত এ কর্মযজ্ঞ। কিন্তু কোনো জাতির ভাষা আন্দোলনের মহিমান্বিত ঘটনাকে ঘিরে বইমেলার ধারণা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এ জায়গাতেই বাংলাদেশের এই অমর একুশে বইমেলার স্বাতন্ত্র্য ও বিশেষত্ব।
ভাষা আন্দোলনের চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ এবং প্রসারের জন্য মাসব্যাপী বইমেলা বাংলাদেশের সংস্কৃতিচর্চার একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। ‘অমর একুশে বইমেলা’ শিরোনামটিই বলে দিচ্ছে এর গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ব্যাপ্তি। এই বইমেলা শুধু বই বিক্রির মেলা নয়, এর সঙ্গে সম্পর্কিত আমাদের অস্তিত্বের শিকড় ও জাতিগত প্রেরণা।
এই মেলা লেখক, প্রকাশক, পাঠক ও সংস্কৃতিচর্চাকারীদের মধ্যে একটা নৈকট্য তৈরির সুযোগ হয়ে ওঠে প্রতি বছর। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই আয়োজন কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশে উৎসাহের আমেজ বিরাজ করে। রাজধানীর মানুষের কাছে মাসব্যাপী বিশেষ আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে যেন এই বইমেলা।
বই ঘিরে এ এক অসাধারণ উপলক্ষ। তবে এ বইমেলার শুরুটা যখন ও যেভাবে হয়েছিল, তখন কেউ হয়তো ভাবতেও পারেননি যে, একদিন বইমেলার পরিসর, ব্যাপ্তি, কার্যক্রম, প্রত্যাশা এবং অঙ্গীকার এতটা বিস্তৃত হবে। বছরে কয়েক হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয় শুধু এই বইমেলা কেন্দ্র করে। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাসসহ বহুধারার বিচিত্র বিষয় নিয়ে প্রকাশিত এ বইয়ের মধ্য থেকে পছন্দের বইটি সংগ্রহ করতে আসেন হাজারো বইপ্রেমী মানুষ। আরও লাখ লাখ মানুষের পদচারণার একটি উন্মুক্ত ক্ষেত্রে পরিণত হয় ফেব্রুয়ারির এ বইমেলা। তরুণ-প্রবীণ পাঠকদের পাশাপাশি আসে শিশু-কিশোররাও। এ মেলায় তাদের জন্য আকর্ষণীয় জায়গাটির নাম শিশুচত্বর। এই চত্বরে থাকে শিশুদের পাঠোপযোগী বইয়ের সমাহার। প্রতি শুক্রবার শিশুদের জন্য থাকে শিশুপ্রহর। সারা দেশ থেকে যেমন মেলা উপলক্ষে লেখক-পাঠকদের সমাগম হয়, তেমনি দেশের সীমানার বাইরে বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশি লেখক-পাঠকের পদচারণায় ঢেউ ওঠে একুশের বইমেলা মাঠের ধুলায়। বহু গ্রন্থানুরাগী সারা বছর উন্মুখ হয়ে থাকেন এই বইমেলার জন্য। লেখক-পাঠক-দর্শক সব শ্রেণির মানুষের এই মিলনমেলা সবাইকে নানাভাবে আলোড়িত করে। প্রণোদিত করে গ্রন্থ প্রকাশকদেরও। ফেব্রুয়ারির আগে থেকেই ছাপাখানাগুলো সরগরম হয়ে ওঠে বই ছাপানোর তুমুল আওয়াজে। সৃজনশীল বই প্রকাশের এই মহাযজ্ঞে জড়িয়ে থাকে নানা পেশার মানুষের শ্রম ও মেধার পরিচয়।
গত পাঁচ দশকের ইতিহাস থেকে বলা যায়, আমাদের দেশে বইমেলার কারণে লেখকের সংখ্যা বেড়েছে এবং হয়তোবা লেখকের সংখ্যা বৃদ্ধি ও উৎসাহের কারণে প্রকাশকের সংখ্যাও বেড়েছে। ২০১৪ সালের আগে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু প্রকাশকের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এরপর এই প্রাঙ্গণে স্থান সংকুলান না হওয়ায় একাডেমি প্রাঙ্গণের বাইরের রাস্তায় স্টল বরাদ্দ দেওয়া হতো। পরবর্তী সময়ে তাতেও স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই উদ্যানে মেলা স্থানান্তরিত হওয়ার সময় থেকে চিরাচরিত স্টলের সঙ্গে নতুনভাবে যুক্ত হয় ‘প্যাভিলিয়ন’।
‘অমর একুশে বইমেলা’ শুধু বই বিক্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই মেলা সার্থক করে তোলার জন্য আরও বিভিন্ন কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘লেখক বলছি’ নামে একটি মঞ্চ সংযোজিত হয়েছে চার বছর ধরে। প্রতিদিন আমন্ত্রিত লেখকরা তাদের লেখালেখি নিয়ে কথা বলেন এই মঞ্চে। এ ছাড়া থাকে সবার জন্য ‘মোড়ক উন্মোচন মঞ্চ’।
বইমেলাকে বহুজন ‘প্রাণের মেলা’ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। এই মেলার সঙ্গে যেমন জড়িয়ে আছে আমাদের ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, তেমনি দিনে দিনে এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে সংস্কৃতি ও সামাজিক বিকাশের চর্চাটিও। অন্যদিকে, বাঙালি জীবনের চিরায়ত মেলাসংস্কৃতির ইতিহাস যুক্ত হয়ে বইমেলা বাস্তবিকই একটি প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করেছে। প্রতি বছর শীত ও বসন্তের সংযোগলগ্নে সেই প্রাণকেন্দ্রটি মুখরিত হয়ে ওঠে একুশের চেতনায়, সংস্কৃতির উৎসবে।
মেলা উপলক্ষে শিথিল ঢাবির যানবাহন নিয়ন্ত্রণ বিধি: নির্বিঘ্নে বইমেলায় জনসাধারণের অংশগ্রহণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রবেশপথগুলোয় যানবাহন নিয়ন্ত্রণের বিধিনিষেধ শিথিল করেছে প্রশাসন। গতকাল শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়ে জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অমর একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। সারা দেশ থেকে বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ এ বইমেলা উপভোগ করতে আসেন। বইমেলা উপভোগ করতে আসা ক্রেতা এবং দর্শনার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে আসা-যাওয়া নির্বিঘ্ন করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথগুলোয় যানবাহন নিয়ন্ত্রণের যে বিধিনিষেধ থাকে তা শিথিল করা হলো। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো ব্যারিকেড রাখবে না। তবে, ঢাকা মহানগর ট্রাফিক বিভাগ এ প্রবেশপথগুলোতে যানবাহন সুশৃঙ্খলভাবে প্রবেশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে যানবাহনগুলো সুশৃঙ্খলভাবে পার্কিং করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবক দল এবং প্রক্টরিয়াল মোবাইল সিকিউরিটি টিমের সদস্যরা ট্রাফিক বিভাগকে এ ব্যাপারে সার্বিক সহায়তা করবেন।