আজ শুক্রবার (৮ আগস্ট) অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হলো।এই এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের বেশকিছু সাফল্য যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ব্যর্থতাও। বলা যায়, অম্ল-মধুর একটি বছর কেটেছে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য। ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপও ঘোষণা করা হয়েছে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের ১২ মাসে ১২টি বড় সাফল্যের তথ্য তুলে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। সরকারের সেই ১২ অর্জনগুলো হলো—
১. শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে শান্তি ও আইনশৃঙ্খলা ফিরে আসে, যা প্রতিশোধ ও বিশৃঙ্খলার চক্র বন্ধ করে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নৈতিক নেতৃত্ব ছিল এই স্থিতিশীলতার প্রধান চালিকা শক্তি, যিনি দেশকে সহিংসতার বদলে পুনর্মিলন ও গণতন্ত্রের পথে পরিচালিত করেন।
২. অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন : ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ শতাংশ থেকে অর্ধেকে নামানো হয়, সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে আসে (৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন), প্রবাসী আয় ৩০.৩৩ বিলিয়ন ডলারে রেকর্ড সৃষ্টি করে, রপ্তানি ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং দীর্ঘসময় পর টাকার মান ডলারের বিপরীতে শক্তিশালী হয়। ব্যাংক খাত স্থিতিশীল হয়।
৩. বাণিজ্য ও বিনিয়োগে অগ্রগতি : যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক সংক্রান্ত আলোচনায় সফল সমাপ্তি ঘটে (অনেকেই বলেছিলেন দুর্বল সরকার পেরে উঠবে না), উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ আসে (হান্ডা গ্রুপের ২৫ কোটি ডলারের টেক্সটাইল বিনিয়োগ, যা ২৫,০০০ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে), গত সরকারের তুলনায় দ্বিগুণ এফডিআই প্রবাহ নিশ্চিত হয়। চীনা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
৪. গণতান্ত্রিক সংস্কার ও জুলাই সনদ : সংস্কার কমিশন গঠন, ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের মধ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা এবং ঐতিহাসিক জুলাই সনদ চূড়ান্ত করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে স্বৈরতন্ত্র ফিরে আসার পথ রোধে কাঠামোগত জবাবদিহি নিশ্চিত করবে। এই সনদ গণতন্ত্রের এক নতুন যুগের সূচনা করবে।
৫. জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার : জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের স্বচ্ছ বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে চারটি বড় মামলার বিচার চলছে। শেখ হাসিনার বিচার শুরু হয়েছে।
৬. নির্বাচন পরিকল্পনা ও সংস্কার : ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রবাসী, প্রথমবারের মতো ভোটার হওয়া তরুণ এবং নারীদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে। নাগরিক মতামতের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু হচ্ছে। নির্বাচনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৮ লাখ পুলিশ, আনসার ও সেনা সদস্য মোতায়েনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
৭. প্রতিষ্ঠানিক ও আইনি সংস্কার—
* বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরও মজবুত করা হয়েছে।
* পুলিশ সংস্কার : মানবাধিকার সেল, বডিক্যাম, স্বচ্ছ জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ, জাতিসংঘ মানের প্রতিবাদ নিয়ন্ত্রণ প্রটোকল চালু।
* আইনি সংস্কার : দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধিতে বড় পরিবর্তন, গ্রেফতারের পর ১২ ঘণ্টার মধ্যে পরিবারের কাছে জানানো বাধ্যতামূলক, আইনজীবীর অ্যাক্সেস, চিকিৎসা সুরক্ষা ও অনলাইন জিডির সুযোগ চালু।
৮. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও ইন্টারনেট অধিকার : দমনমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল, সব সাংবাদিকের মামলার অবসান, সমালোচনার স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইন্টারনেট অ্যাক্সেসকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা।
৯. পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন : একক দেশের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে সরে এসে বহুমাত্রিক ও ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি গড়ে তোলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন অংশীদারের সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, চিকিৎসা সহায়তা ও সংকট মোকাবেলায় সহযোগিতা সম্প্রসারণ। সার্কের পুনর্জাগরণ ও আসিয়ানে সদস্যপদ অর্জনের প্রচেষ্টা শুরু।
১০. প্রবাসী ও শ্রমিকদের অধিকার : আমিরাতে ভিসা পুনরায় চালু, মালয়েশিয়ায় একাধিকবার প্রবেশের ভিসা চালু। উপসাগরীয় অঞ্চলে অবৈধ শ্রমিকদের বৈধতা দেওয়া। জাপানে ১ লাখ তরুণ পাঠানোর উদ্যোগ এবং ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া ও সার্বিয়ায় আরও শ্রমিক পাঠানোর পরিকল্পনা গ্রহণ।
১১. শহীদ ও আহত বিপ্লবীদের সহায়তা : জুলাই বিপ্লবের শহীদ ও আহতদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। ৭৭৫ শহীদ পরিবারের মাঝে প্রায় ১০০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ও ভাতা এবং ১৩ হাজার ৮০০ আহত বিপ্লবীর মাঝে ১৫৩ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। গুরুতর আহতদের বিদেশে উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
১২. সমুদ্র ও অবকাঠামো উন্নয়ন : বঙ্গোপসাগরকে ‘জলভিত্তিক অর্থনীতির’ মূল সম্পদ ঘোষণা। চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বাড়ানো হয়েছে (প্রতিদিন অতিরিক্ত ২২৫ কনটেইনার পরিচালনা), উপকূলীয় উন্নয়ন প্রকল্প সম্প্রসারণ এবং গভীর সমুদ্রের মৎস্য ও শিল্প প্রকল্পে বৈশ্বিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ শুরু।
আওয়ামী লীগের পতনের পর গত এক বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী কর্তৃক হত্য,গুম বা জুডিশিয়াল কিলিংয়ের কোনো অভিযোগ উঠেনি।
অন্যদিকে প্রেস সচিবের উল্লেখ করা অন্তর্বর্তী সরকারের ১২ সাফল্যের বিপরীতে ১২টি ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেছেন গণঅধিকার পরিষদের রাশেদ খান। তার মতে, ‘হাসিনা দেশ ছেড়েছে’— এটাই যেন এই সরকারের বড় সফলতা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর এই এক বছরে ১২টি ব্যর্থতা তথা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি সরকার।
তার মতে, সারা দেশের আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। বরং সর্বত্র তাদের পুনর্বাসন করা হয়েছে।
শেখ পরিবারের কেউ ধরা পড়েনি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানসহ গত ১৬ বছরে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির যারা গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে, তারা চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার হয়নি। প্রশাসনের যারা হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বানাতে সহযোগিতা করেছে সেসব সচিব, ডিসি, এসপিরা গ্রেপ্তার হয়নি।
পুলিশ ও প্রশাসনের কোনো সংস্কার হয়নি। এখনও তদবির বাণিজ্য, ঘুস, দুর্নীতি সবই চলছে। যে এনএসআই, ডিজিএফআই আয়নাঘর বানিয়েছে, ৩টা অবৈধ নির্বাচন করেছে, গুম-খুন করেছে, সেই গোয়েন্দা সংস্থার ন্যূনতম সংস্কার ও দোষীরা শাস্তির আওতায় আসেনি।
গত ১৬ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের ক্যাডার যারা শিক্ষক হিসেবে ও অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ঢুকেছে তারা বহাল তবিয়তে। ১৬ বছরে যারা অবৈধ নিয়োগ পেয়েছে, তারা চাকরিচ্যুত হয়নি।
যে মিডিয়া হাসিনার তোষামোদি করতো, যে সাংবাদিকরা হাসিনার ফ্যাসিবাদের সহযোগী, সেই গণমাধ্যমের কোনো সংস্কার হয়নি। বিচার বিভাগ, সচিবালয়, বিভিন্ন দপ্তর ও সেক্টর এবং স্থানীয় প্রশাসনে আওয়ামী সেটআপ পুরোপুরি বহাল। সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ব্যক্তি সংস্কার বা জাতিকে কাউন্সেলিং করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ১৬ বছরে আমাদের প্রজন্ম ফ্যাসিবাদী কাঠামোর মধ্যে বেড়ে উঠেছে, তাদেরকে মেন্টাল কাউন্সেলিংয়ের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতের আমূল পরিবর্তনে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে ছিল আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে চীন, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে এ সরকারের স্বীকৃতি আদায় ও গণঅভ্যুত্থানের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য করে তোলা।
পাশাপাশি চলমান রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান, ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর অগ্রগতি এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই এক বছরে বিশ্ব রাজনীতিতে বহু পরিবর্তন, দক্ষিণ এশিয়ায় বাণিজ্য প্রতিযোগিতা, বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে সরকারকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে সরকারের কূটনৈতিক সাফল্যের ক্ষেত্রে মোটাদাগে কোনো বিষয় চোখে না পড়লেও বেশকিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যনীতি অন্যতম সফল কূটনীতির উদাহরণ।
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছে, যেখানে ভারত পেয়েছে ৫০ এবং পাকিস্তান ১৯ শতাংশ। এর ফলে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, অন্তরর্বর্তী সরকারের আরেকটি সাফল্য হলো ‘টাইগার শার্ক ২০২৫’। এটি প্রতিরক্ষা কূটনীতিতে অভূতপূর্ব সমন্বয়ের উদাহরণ। ‘টাইগার শার্ক’ মহড়া বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা অংশীদারত্বে একটি ঐতিহাসিক মোড়। এতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী একযোগে অংশগ্রহণ করে।
কূটনৈতিক আরেকটি সাফল্য হলো মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার আবার উন্মুক্তকরণ। এ বছরের মে মাসে মালয়েশিয়ার সরকার বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য শ্রমবাজার আংশিকভাবে খুলে দেয়। এর মাধ্যমে কনস্ট্রাকশন, টুরিজম, পরিষেবা এবং কৃষি খাতে নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়।
তবে অন্তরবর্তী সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে জোরালো বক্তব্য দিলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়েছে। চীনের মধ্যস্থতায় পুনর্বাসনের কথা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। কক্সবাজারে মানবিক সহায়তা তহবিলে ২০ শতাংশ ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

                                    
