গ্রামের মাটির পথ পেরিয়ে এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের বোলিং গ্রিন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে (BGSU) সহকারী অধ্যাপক।
শাহজাদপুর উপজেলার বেলতৈল ইউনিয়নের শিবরামপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া তুষার তিন ভাইবোনের মধ্যে বড়। তাঁর বাবা বকুল হোসেন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এবং মা একজন গৃহিণী। গ্রামের সাধারণ পরিবেশেই বেড়ে ওঠা এই তরুণ ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী ও পরিশ্রমী।
২০০৫ সালে তিনি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি অর্জন করেন এবং ২০০৭ সালে শাহজাদপুর উপজেলা গণিত অলিম্পিয়াডে প্রথম স্থান লাভ করেন। শাহজাদপুর পাইলট হাই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ+ অর্জন করেন তিনি, যেখানে তাঁর গড় নম্বর ছিল ৯৩ শতাংশেরও বেশি।
এরপর ভর্তি হন দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নটর ডেম কলেজে। পরবর্তীতে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য যোগ দেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট), সেখান থেকে সম্পন্ন করেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি।
শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগ তাঁকে পৌঁছে দেয় যুক্তরাষ্ট্রে লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি (LSU) এর পিএইচডি প্রোগ্রামে। সেখানে তিনি অর্জন করেন মর্যাদাপূর্ণ Economic Development Assistantship (EDA) Fellowship, যা বিশ্বের শীর্ষ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেবলমাত্র কয়েকজনকেই প্রদান করা হয়। তাঁর গবেষণার মূল ক্ষেত্র ছিল নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বিশেষ করে অফশোর উইন্ড ফার্মের রক্ষণাবেক্ষণ ও লজিস্টিক্স ব্যয় কমানোর নতুন কৌশল উদ্ভাবন।
LSU-তে তাঁর একক গবেষণা ও পরিশ্রমের ফলস্বরূপ ৫টি আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় এবং একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি গবেষণা উপস্থাপন করেন।
বর্তমানে ড. তুষার যুক্তরাষ্ট্রের বোলিং গ্রিন স্টেট ইউনিভার্সিটি (BGSU), ওহাইও-তে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। সেখানে তিনি সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, অপ্টিমাইজেশন, আধুনিক ম্যানুফ্যাকচারিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করছেন। শিক্ষাদান ও গবেষণায় AI এর সফল প্রয়োগের জন্য তিনি ২০২৫ সালে অর্জন করেছেন AI Champion Award, যা BGSU কর্তৃপক্ষ প্রদান করে।
BGSU-তে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন Advanced Industrial and Manufacturing Systems (AIMS) Lab, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের গবেষকরা কাজ করছেন। এর মধ্যে ছয়জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীও গবেষণায় যুক্ত আছেন, যারা তাঁর নেতৃত্বে সাপ্লাই চেইন ও ম্যানুফ্যাকচারিং সিস্টেমের জটিল সমস্যা সমাধানে কাজ করছেন।
এছাড়া তিনি ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন (NSF), অ্যামাজন রিসার্চ অ্যাওয়ার্ডস, এবং ওহাইও ডিপার্টমেন্ট অব হায়ার এডুকেশন (ODHE) এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থায় ৩.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের গবেষণা প্রস্তাব জমা দিয়েছেন। এসব প্রস্তাব তাঁর গবেষণার ব্যাপ্তি ও আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের সাক্ষ্য বহন করে।
গবেষণার পাশাপাশি ড. তুষার যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা অনুদান প্রস্তাব মূল্যায়নকারী বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং বিশ্বখ্যাত জার্নালের রিভিউয়ার হিসেবেও কাজ করছেন।
নিজের অর্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. তুষার বলেন, আমি আমার শিকড়কে কখনও ভুলিনি। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল একদিন বিশ্বমঞ্চে দেশের প্রতিনিধিত্ব করব। শাহজাদপুর পাইলট হাই স্কুল থেকে শুরু করে নটর ডেম কলেজ, বুয়েট, LSU এবং এখন BGSU, এই যাত্রা আমার জীবনের প্রমাণ যে, পরিশ্রম ও অধ্যবসায় থাকলে গ্রাম থেকে উঠে এসে বিশ্বজয় সম্ভব।
ড. ইমরান হাসান তুষারের এই সাফল্য শুধু তাঁর নিজের নয়, এটি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণার দৃষ্টান্ত।


