পীর হিসেবে জাহির করা এই প্রকৌশলীর লুটপাটের সঙ্গী আবার তার স্বীকৃত মুরিদরা। ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করেন মুরিদ এবং ঠিকাদার নুসরত হোসেন। অন্তত এক ডজন প্রকৌশলী এসব অপকর্মের সরাসরি অংশীদার।
মুরিদদের কাছে তার পরিচিতি নারায়ণগঞ্জের ভূঁইগড়ের হাকিমাবাদ খানকা-ই-মোজাদ্দেদিয়ার ‘পীর সাহেব’ আল্লামা হজরত মোহাম্মদ শামীম আখতার (মাদ্দাজিল্লুহুল আলী)। দেশ-বিদেশে খানকা শরিফের শাখায় পীরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তার ভক্ত-আশেকানরা। তবে পীরগিরির আড়ালে ঢাকা পড়েছে শামীম আখতারের মূল পরিচয়। পীর-মুরিদের তেলেসমাতিতে বোঝার উপায় নেই, তিনি দেশের অবকাঠামো খাতের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী। আর তার আড়ালে থাকা এই পরিচয় ব্যবহার করে গণপূর্তে কায়েম করেছেন মুরিদানি শাসন। পীর সাহেবের পছন্দের মুরিদরাই নিয়ন্ত্রণ করেন সব ঠিকাদারি কাজ।
কয়েকদিন আগে মোহাম্মদপুর থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব শাহ কামালকে ৩ কোটি টাকাসহ আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সূত্র বলছে, কিংডম বিল্ডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অফিস থেকে আটক হন সাবেক ওই সচিব। কিংডম কনস্ট্রাকশন, কিংডম হাউজিং এবং কিংডম বিল্ডার্সের চেয়ারম্যান শাহ কামাল। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুসরত হোসেন। উভয়েই শামীম আখতারের মুরিদ। এর মধ্যে নুসরত হোসেন মূলত গণপূর্তের সব রকম ঠিকাদারি কাজের ব্যবস্থাপনা, বণ্টন এবং কমিশন আদায় করেন।
গণপূর্তের অন্তত এক ডজন ঠিকাদার জানান, প্রায় চার বছর ধরে গণপূর্তের সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন নুসরত হোসেন। প্রধান প্রকৌশলীর মুরিদ পরিচয়ে তিনি সাধারণ ঠিকাদার এবং প্রকৌশলীদের জিম্মি করে রেখেছেন। যে কোনো কাজ ১০% কমিশন ছাড়া বণ্টন করা হয় না। অন্তত তিনজন ঠিকাদার বলছেন, নুসরত হোসেনের কাছে অনেক ঠিকাদার অগ্রিম টাকা দিয়ে রেখেছেন। যাতে ভবিষ্যতে কাজ পাওয়া যায়।
গণপূর্তের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, বর্তমানে বিভিন্ন প্রকল্পে প্রায় শতকোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে নুসরতের কিংডম বিল্ডার্সের। গত চার বছরে এই কোম্পানি অন্তত ২০০ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ করেছে। তবে ঠিকাদাররা বলছেন, নুসরত নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে কম কাজ করেন। তিনি মূলত প্রধান প্রকৌশলীর ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করেন। সব কাজ ঠিকাদারদের মধ্যে বণ্টন এবং কমিশন আদায় করেন।
জানা যায়, ২০২০ সালে ছয়জনকে ডিঙিয়ে প্রধান প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল শামীম আখতারকে। মন্ত্রীদের সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে প্রভাব বিস্তার করে মেধাতালিকায় ৭ নম্বরে থাকার পরও প্রধান প্রকৌশলী পদে চলতি দায়িত্ব পান তিনি। প্রায় চার বছর ধরে তিনি গুরুত্বপূর্ণ এই পদে চলতি দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ছয় মাসের বেশি কাউকে চলতি দায়িত্ব প্রদান করার সুযোগ নেই।
গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার আগে শামীম আখতার হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) মহাপরিচালক ছিলেন। সেখানেও মুরিদদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন ‘পীর সাহেব’। কখনো প্রকল্প পাস হওয়ার আগেই, কখনো দরপত্র ছাড়াই কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ পেয়ে যেতেন মুরিদ-ঠিকাদাররা। লাখ টাকা বেতনে প্রকল্পের পরামর্শক, কর্মকর্তা-প্রকৌশলী থেকে বাবুর্চি-মালির মতো পদগুলোয় নিয়োগের ক্ষেত্রেও ছিল একই অবস্থা। তৎকালীন মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে মুরিদদের ঠিকাদারিসহ নানা সুবিধা দেওয়ার তিনটি অভিযোগের প্রমাণ পায় এইচবিআরআইর তদন্ত কমিটি। এক বছর আগে তদন্ত প্রতিবেদন সচিবের কাছে জমা দিলেও বিগত সরকারের একাধিক মন্ত্রীকে দিয়ে তদবির করিয়ে প্রতিবেদনটি ধামাচাপার ব্যবস্থা করেন প্রকৌশলী শামীম আখতার।
পীর সাহেবের আরেক ঘনিষ্ঠ মুরিদ মোহাম্মদ ইয়ামীন। ক্যামিকন গ্রুপ নামে একটি কেমিক্যাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। এইচবিআরআইয়ের মহাপরিচালক থাকাকালে প্রতি মাসে ১ লাখ টাকা বেতনে ইয়ামীনকে স্যান্ড সিমেন্ট ব্লক তৈরির কাজে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেন শামীম আখতার। কোনো টেন্ডার ছাড়াই আড়াই কোটি টাকার কাজ দেন ইয়ামীনকে। নিযুক্ত করেন গবেষণার কাজে। এইচবিআরআইয়ের টাকায় গবেষণা করে উৎপাদন করা কেমিক্যাল এইচবিআরআইয়ের কাছেই বিক্রি করেছেন ইয়ামীন। নিয়মবহির্ভূতভাবে ঠিকাদারি কাজ পাওয়া ছাড়াও রিসার্চ আর্কিটেক্ট, সিনিয়র ড্রাফটসম্যান, সহকারী মেকানিক, পেইন্টার, বাবুর্চি, মালিসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ পেয়েছেন মুরিদরা। মোহাম্মদ শামীম আখতারের বিরুদ্ধে নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে এইচবিআরআই ও দুর্নীতি দমন কমিশনে একাধিক চিঠিও দিয়েছেন এইচবিআরআইয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
গণপূর্তের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সাতটি ভিভিআইপি অনুষ্ঠান বাবদ ২৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। অথচ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই সময়কালে অনুষ্ঠান হয়েছে মাত্র চারটি। সাধারণত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভিভিআইপি প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে গণপূর্ত লাইটিং, মাটি ভরাটসহ আনুসঙ্গিক কাজ করে থাকে।
জানা গেছে, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং গুলশানে তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে বিধিবহির্ভূতভাবে ব্যক্তিগত বাড়ি নির্মাণ করে উপহার দিয়েছেন শামীম আখতার। টুঙ্গিপাড়ার বাড়ির কাজটি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্সকে দিয়ে করানো হয়।
শামীম আখতারের আরেক মুরিদ পাবনার সাজিন কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ঠিকাদার শাহাদত হোসেন। গত চার বছরে নিয়ম না মেনে এই প্রতিষ্ঠানকে অসংখ্য কাজ দিয়েছেন শামীম আখতার। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে আলোচিত বালিশকাণ্ডের ঘটনায় অভিযুক্ত ছিল এই প্রতিষ্ঠান। সিন্ডিকেট করে ইন্টেরিয়রের কাজ করে প্যারাডাইম আর্কিটেক্টস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স। টেন্ডার বিজ্ঞপ্তিতে এমন সব শর্ত আরোপ করা হয়, যাতে প্যারাডাইম আর্কিটেক্টস ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ করতে না পারে।
এদিকে, প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে গত চার বছর দায়িত্ব পালনকালে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বদলি, পুনঃবদলি ও পদায়ন করেছেন শামীম আখতার। উপসহকারী প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে শুরু করে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী—বাদ যায়নি কেউই। বদলি-পদায়ন স্বাভাবিক বিষয় হলেও গণপূর্তে এ নিয়ে চলেছে তুঘলকি কাণ্ড। আক্রোশের শিকার হয়েছেন অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ ও সাবেক গণপূর্ত সচিব শহীদুল্লাহ খন্দকারের আমলে তৈরি হওয়া একটি সিন্ডিকেটকে এখনো বহাল রেখেছেন শামীম আখতার। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শহিদুল আলম, প্রায় নয় বছর ধরে ঢাকায় থাকা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ইলিয়াস হোসেন, নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুজ্জামান চুন্নু, আইনুন নাহান এ্যানি, ফজলুল হক মধু, প্রধান প্রকৌশলীর স্টাফ অফিসার মাহফুজুল আলমের এই সিন্ডিকেট এখনো বজায় রয়েছে।
অভিযোগ আছে, সালমান এফ রহমানসহ আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাশালী দুর্নীতিবাজদের সহযোগী ছিলেন শামীম আখতার। সর্বোচ্চ দরদাতাকে বাদ দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে সালমান এফ রহমানের মনোনীত ব্যক্তিকে রমনা পার্কের ভেতরের চায়নিজ রেস্টুরেন্ট লিজ দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া শামীম আখতারের বিরুদ্ধে রয়েছে নিয়োগ সংক্রান্ত অভিযোগ। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন পদে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস, ফলাফল পাল্টে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে শামীম আখতারের আমলে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি ।
সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান প্রকৌশলীর স্টাফ অফিসার মাহফুজুল আলম বলেন, ‘আমি কোনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত নই। দরপত্র আহ্বান ও ঠিকাদার বাছাই হয় মাঠপর্যায়ে। এতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’