কক্সবাজারের অন্যতম পুরনো এবং কথিত পাঁচ তারকা মানের হোটেল ‘সিগাল’ এখন নানা অভিযোগে জর্জরিত। একসময় পর্যটকদের আকর্ষণের প্রতীক হলেও বর্তমানে এটি পরিণত হয়েছে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও নিরাপত্তাহীনতার কেন্দ্রবিন্দুতে।
প্রাইভেট বীচে খুন, আতঙ্কে পর্যটকরা
সম্প্রতি হোটেলটির নিজস্ব প্রাইভেট বীচে টিপু নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করার ঘটনায় কক্সবাজারে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শী অটোচালক আব্দুস সালাম বাবু বলেন, ‘গুলির শব্দ শুনে দেখি একজন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। আমরা দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে তার পরিচয় জানা যায়।’
এ ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে— এত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়, তথাকথিত পাঁচ তারকা হোটেলের সামনে যদি খুনের ঘটনা ঘটে, তাহলে অতিথি ও পর্যটকদের নিরাপত্তা কোথায়?
নিরাপত্তাহীনতা ও অব্যবস্থাপনা
অভিযোগ রয়েছে, হোটেল সিগালে নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রবেশদ্বারে তল্লাশি নেই, অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষীর দেখা মেলে না। বাইরের লোকজন সহজেই হোটেলে প্রবেশ করে ছবি তোলে, সুইমিং পুল ভাড়ায় দেয় বাইরের অতিথিদের কাছে; যা অন্য পাঁচ তারকা হোটেলে কল্পনাতীত।
সায়মন, ওশান প্যারাডাইসসহ অন্য তারকা হোটেলগুলোয় কঠোর নিরাপত্তা থাকলেও সিগালে তার কোনো বালাই নেই বলে অভিযোগ করেছেন অতিথিরা।
অবহেলা, অনিয়ম ও গ্রাহক ভোগান্তি
হোটেলের পানির লাইনে আসে ময়লা পানি, সেন্ট্রাল এসি প্রায়ই বিকল থাকে। অতিথিদের অভিযোগ, রুম ও বাথরুম পুরনো, সংস্কারের অভাবে বিশ্রী দেখায়। চাদর-মশারি নোংরা, বাথরুমে কালো পানি, ওয়াই-ফাই দুর্বল, খাবারে অস্বাস্থ্যকর গন্ধ।
এমনকি, চেকইনের সময় অতিথিদের সঙ্গে স্টাফদের অশোভন আচরণও নিয়মিত ঘটনা বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, অপ্রাপ্তবয়স্কদেরও ঘুষের বিনিময়ে এনআইডি ছাড়া রুম বরাদ্দ দেওয়া হয়। রাতে হোটেলের লবিতে দেখা যায় সন্দেহজনক ব্যক্তিদের আড্ডা, যা নারী অতিথিদের বিব্রত করে।
‘পাঁচ তারকার’ আড়ালে অবৈধ কর্মকাণ্ড
এলাকাবাসীর দাবি, রাতে হোটেলের ভেতরে অবৈধ আড্ডা বসে, চলে অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েদের অবাধ মেলামেশা। এতে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘নামে পাঁচ তারকা, কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যায়, সিগাল আসলে অব্যবস্থাপনার স্তূপ।’
প্রতিবেদককে হুমকি
এসব অনিয়ম নিয়ে জানতে হোটেল সিগালের মার্কেটিং ম্যানেজার সাজিতের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথমে বলেন, ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তিনি প্রতিবেদককে সংবাদ প্রকাশ না করতে চাপ দেন এবং হুমকি দেন; নিউজ করলে মামলা করবেন ও দেখে নেবেন। পরে অন্য সাংবাদিকরা যোগাযোগ করলে তাদের সঙ্গেও তিনি দুর্ব্যবহার করেন।
এ ঘটনায় সাংবাদিক মহলে তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা বলছেন, সংবাদ প্রকাশে বাধা দেওয়া ও ভয়ভীতি দেখানো গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত।
প্রতিবেদক একাধিকবার হোটেলের সিওও গাজী সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
প্রশ্ন উঠেছে, কার ছত্রছায়ায় চলছে সিগাল?
স্থানীয় সাংবাদিক ও সচেতন মহলের প্রশ্ন, কাদের সহযোগিতায় এমন দুঃসাহস পাচ্ছেন সিগাল কর্তৃপক্ষ? দীর্ঘদিনের অনিয়ম, রাতের অবৈধ কর্মকাণ্ড ও প্রশাসনিক নীরবতা; সবকিছুর পেছনে কি কোনো প্রভাবশালী মহলের ছায়া আছে?
তাদের দাবি, এ ঘটনায় প্রশাসনের স্বতঃস্ফূর্ত তদন্ত ও কঠোর পদক্ষেপ জরুরি।
সরকারি জমি দখলের পুরনো অভিযোগ
এর আগে, ২০১৪ ও ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছিল, হোটেল সিগাল কক্সবাজার সৈকতের সরকারি জমি অবৈধভাবে দখল করেছে। উচ্ছেদ অভিযানের পরও হোটেল কর্তৃপক্ষ আবারও প্রায় ২৫ কোটি টাকার সরকারি জমি পুনর্দখল করে নেয়।
বিশেষজ্ঞদের মত
পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, সিগালের মতো পুরনো হোটেলগুলোর অনিয়ম কক্সবাজারের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
তাদের মতে, প্রশাসন ও পর্যটন বোর্ড যদি নিয়মিত পরিদর্শন না বাড়ায়, তবে এমন তথাকথিত পাঁচ তারকা হোটেলগুলো পর্যটকদের আস্থা হারাবে; যা দেশের পর্যটন শিল্পের জন্য বড় বিপদ সংকেত।