সাতচল্লিশ থেকে চব্বিশের আন্দোলন একটি জাগরণ, একটি গণঅভ্যুত্থান। দেশের প্রতিটি আন্দোলনই বাঙালীর রক্তে রাঙানো ইতিহাস।
“সাতচল্লিশের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভূত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান: প্রতিটি আন্দোলনই বাঙালির রক্তে রাঙা ঐতিহ্য। এগুলো বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের ইতিহাস ও সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।
সাতচল্লিশ থেকে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান
প্রতিটি আন্দোলনই বাঙালির ঐতিহ্য, ইতিহাস, মর্যাদা, সার্বভৌমত্বের সংগ্রাম। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসকে যদি একটি দীর্ঘ সংগ্রামের আখ্যান বলা হয়, তাও কম বলা হবে না।
১৯৪৭ সালের দেশভাগ থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের রাজপথে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপেই লুকিয়ে আছে আত্মত্যাগ, অধিকার আদায়ের সংগ্রাম এবং একটি জাতিকে জাগ্রত করার গল্প।
এই দীর্ঘ পথচলায় প্রতিটি গণআন্দোলন শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনাই নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে বাঙালির আত্মপরিচয়ের ঐতিহ্য ও চেতনার অঙ্গ।
১৯৪৭: দেশভাগ ও পূর্ব বাংলার নতুন বাস্তবতা
ব্রিটিশ উপনিবেশের অবসান হলেও, বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাংশ হিসেবে নিজেদের অধিকার নিয়ে নতুন সংকটে পড়ে। ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক উপেক্ষার বিরুদ্ধে অসন্তোষের বীজ তখনই রোপিত হয়।
১৯৫২: ভাষা আন্দোলন; “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”— এই দাবি যেন ছিল বাঙালির হৃদয়ের আর্তনাদ। পাকিস্তান সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার চেষ্টা করলে উত্তাল হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশ।
২১ ফেব্রুয়ারির শহীদ মিনার আর একুশের চেতনা আজ জাতিসংঘ স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এই আন্দোলনই বাঙালিকে দিয়েছে সাংস্কৃতিক জাগরণ ও আত্মমর্যাদার বোধ।
১৯৬৬: ছয় দফা ও বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির ডাক; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবিতে উঠে আসে বাঙালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চোখে তা ছিল বিদ্রোহ, কিন্তু বাঙালির চোখে তা ছিল মুক্তির সনদ। এই আন্দোলনই ৭০-এর নির্বাচনে বিজয় এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি গড়ে দেয়।
১৯৬৯: গণঅভ্যুত্থান ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল আগুন জ্বালানো আন্দোলন। আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার উত্তাল প্রতিবাদে প্রাণ হারান আসাদ, রাশেদ, মতিউররা। এই অভ্যুত্থান পাকিস্তানকে কাঁপিয়ে দেয় এবং শেখ মুজিবকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধি এনে দেয়। এখান থেকেই শুরু হয় স্বাধীনতার অগ্রযাত্রা।
১৯৭১: মহান মুক্তিযুদ্ধ; এটি শুধু একটি যুদ্ধ নয়, এটি ছিল জাতিসত্তার জন্য চূড়ান্ত লড়াই। ৩০ লক্ষ প্রাণ আর ২ লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। এটি ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ গণজাগরণ এবং বাঙালির গৌরবময় ঐতিহ্য।
১৯৯০: স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন; এরশাদ সরকারের স্বৈরাচারী শাসনের অবসানে ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ১৯৯০ সালে সফল হয়। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এই আন্দোলনও বাঙালির গণতান্ত্রিক চেতনার ধারাবাহিকতা।
২০২৪: ডিজিটাল যুগে নতুন প্রজন্মের জাগরণ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংঘটিত প্রতিবাদ, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে গণআন্দোলন প্রমাণ করে এই জাতি এখনও জেগে আছে। শোষণ, দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর তোলাই এই জাতির ঐতিহ্য।
সাতচল্লিশ থেকে চব্বিশ—প্রতিটি গণআন্দোলন বাঙালির ইতিহাসে একটি ছাপ রেখে গেছে। এই ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে, বাঙালি জাতি কখনোই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি। প্রতিটি রক্তের ফোঁটা, প্রতিটি প্রতিবাদের সুর। সব মিলিয়ে গড়ে উঠেছে একটি সংগ্রামী, স্বাধীন, এবং গর্বিত জাতি।
এটাই বাঙালির ঐতিহ্য, এটাই আমাদের অহংকার। বাঙালী জাতি হিসেবে এই সকল চেতনা ধারণ করে এগিয়ে যেতে চাই।
হানাহানী, দূর্ণীতি, অনিয়ম, সেচ্ছাচারী মতবাদ প্রভৃতির বৈচিত্র্যকে পেছনে ফেলে দেশের সকলকে এগিয়ে যাওয়া উচিত। উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাড়াতে কে না চায়! ক্ষুদ্র চিন্তা চেতনা কখনো বৃহৎ একটি জাতিকে ভালো কিছু উপহার দিতে পারে না।
১৮ কোটি বাঙালীর শিশু থেকে শুরু করে আবাল বৃদ্ধ বনিতা, প্রতিবন্ধী নারী-পুরুষ, কিশোর কিশোরী, যুবক-যুবতী এই সমাজেরই একজন। অথচ আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতারা মনে করছে এই সমাজের, এই রাষ্ট্রের মানুষেরা যেনো তাদের কেনা গোলাম!
যুগে যুগে দেশের মানুষের ওপর সংগঠিত রাজনৈতিক হিংসাত্মক তৎপরতা নৈরাজ্য প্রকৃতপক্ষে কোনো সুস্থ মানুষের পরিচতি বহন করে না। রাজনৈতিক দলের লোকেরা যেহেতু সমাজ-রাষ্ট্র চিন্তা ভাবনা করছেন, কভু কি খোঁজ নিয়েছেন এই ভূখণ্ডের সাধারণ মানুষেরা কী চান?
জেনে রাখা উচিত ; আমার মতে এদেশের নিরীহ ৮০ ভাগ নিরীহ মানুষ রাজনৈতিক হিংসাত্মক তৎপরতা নৈরাজ্য এবং লাশের মিছিল দেখতে চায় না। তারা দেশে শান্তি চায়, নিরাপদে এবং সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চায়।
বিগত সরকারের ষোল বছরের উঁচু মাপের বেশ কিছু অনিয়ম -দূর্ণীতি, লুটপাট, অবিচার জাতিকে চব্বিশের আন্দোলনের রসদ জোগায়। যা এক সময় গণ-অভ্যুত্থানের রূপে পরিণত হয়ে ওঠে। ছাত্র জনতার এ সংগ্রাম গোটা জাতিকে একটি বিপ্লবের জাগরণ তোলে।
জুলাই -আগস্টের নতুন প্রজন্মের বৈষম্য বিরোধী এ আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখতে সকলকে ন্যায়ের পক্ষে দায়িত্বশীল হতে হবে। মূল্যবোধের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা ও শাসনের পরিবর্তন আনতে পারে।
জুলাই পরবর্তী বড় অন্তরায় হিসেবে মব জাস্টিস চরম নিন্দনীয় অপরাধ হিসেবে পরিগনিত হয়েছে, যা
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের প্রথম ৭‑৮ মাসে অন্তত ১১৮–১৮৫ জন নিহত হয়েছেন গণপিটুনিতে; ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা ছিল ১৭৯ জন। “মব” শব্দটি অর্থ “উচ্ছৃঙ্খল জনতা”. কেউ অপরাধে অভিযুক্ত হলে তারা শাসন হাতে নিয়ে নৃতাত্ত্বিক বিচার করে—যুদ্ধ, দমন, মারধর বা হত্যার মতো সহিংসতার মাধ্যমে, যেখানে অভিযুক্তের কোনো প্রতিরক্ষা বা প্রক্রিয়াজাত সুযোগ থাকে না।
মবের শিকার এরা আমাদের এই সমাজেরই মানুষ। বিনা বিচারে হত্যা বা মৃত্যু সমাজ, রাষ্ট্র এবং আইন কোনটাই সমর্থন করেনা।
দেশের সম্মান রক্ষায় সকল রাজনৈতিক দল,মত নির্বিশেষে সুশাসন, ন্যায় বিচার, ভোটাধিকার ও জনগনের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে এখনই ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত।