শনিবার, নভেম্বর ১৬, ২০২৪
শনিবার, নভেম্বর ১৬, ২০২৪
29 C
Dhaka
Homeমতামতএক্সপ্রেসওয়ে না মৃত্যুর মহাসড়ক - প্রভাষ আমিন

এক্সপ্রেসওয়ে না মৃত্যুর মহাসড়ক – প্রভাষ আমিন

প্রকাশ: মার্চ ২০, ২০২৪ ১২:০২

গত সপ্তাহে একবেলার জন্য কুমিল্লা গিয়েছিলাম। কুমিল্লা আমার জন্মশহর নয়, তবে এ শহরে আমার অনেক স্মৃতি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে আমি ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র ছিলাম। আন্দোলন-সংগ্রাম, মিছিল-সমাবেশে মহিমান্বিত ছিল আমাদের যৌবন। শান্ত, ছিমছাম কুমিল্লা একসময় ছিল ব্যাংক আর ট্যাংকের শহর। এখন পরিণত হয়েছে রিকশা আর টমটমের শহরে। রাস্তায় থিকথিকে জ্যাম। সড়কের এক ইঞ্চিও যেন ফাঁকা নেই।

শুক্রবার ছুটির দিনের বিকেলে মোগলটুলী থেকে বাখরাবাদের দিকে যাচ্ছিলাম। পাশে বসা বড় বোনকে বললাম, ভাবা যায়, একসময় এ সড়কটিই ছিল ঢাকা-চট্টগ্রামের মূল সড়ক। সব গাড়ি কুমিল্লা শহরের ভেতর দিয়েই চলাচল করত। ঢাকা থেকে আসা গাড়ি শাসনগাছা দিয়ে ঢুকে চকবাজার দিয়ে বেরিয়ে যেত। এখন যেমন হাইওয়েতে অনেক রেস্টুরেন্ট, তখন তেমন ছিল না। সব গাড়ি চকবাজারে বিরতি নিত। সেখানে কিছু দেশি হোটেল ছিল। সেখানেই সবাই খাওয়া-দাওয়া সারত। আমার গ্রামের বাড়ি দাউদকান্দি, কুমিল্লার প্রথম উপজেলা। আর পড়াশোনা করতাম চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লার শেষ উপজেলা। ছুটিছাটায় আমাকে চৌদ্দগ্রাম-দাউদকান্দি আসা-যাওয়া করতে হতো। তখন এই চকবাজারে অনেকবার বিরতি নিয়েছি।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটিকে বলা হয় বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন। রাজধানীকে বন্দরনগরীর সঙ্গে যুক্ত করেছে এ সড়ক। আমদানি-রপ্তানির অনেকটাই নির্ভর করে এ মহাসড়কের ওপর। ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের অংশ এ মহাসড়কটির অনেক বিবর্তন আমি চোখের সামনে দেখেছি। আসলে দেখতে হয়েছে। কারণ আমাদের গ্রামের বাড়ি দাউদকান্দির শহীদনগরে। আর মহাসড়কের সঙ্গের প্রথম বাড়িটিই আমাদের। একটু বড় গলায় বলতে পারি, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক আমাদের জায়গায় হয়েছে। কারণ একাধিকবার মহাসড়কের জন্য সরকার আমাদের জায়গা অধিগ্রহণ করেছে। আমরা ছেলেবেলায় মহাসড়কের পাশে বসে গাড়ি গুনতাম। ঢাকার দিকে যাওয়া গাড়ি একজন গুনবে, চট্টগ্রামের দিকে যাওয়া গাড়ি অন্যজন গুনবে। এটা ছিল আমাদের খুব প্রিয় খেলা। ছেলেবেলায় আমাদের খেলার ফুটবল অনেকবার মহাসড়কের গাড়ির নিচে চাপা পড়েছে। এখন তো ঢাকা-সিলেট আলাদা মহাসড়ক হয়েছে। চাঁদপুর যাওয়ারও অনেক বিকল্প হয়েছে। একসময় সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গাড়ি ময়নামতি থেকে বাঁদিকে চলে যেত। চাঁদপুরের গাড়িও শহরে ঢুকে টমছম ব্রিজ দিয়ে বের হয়ে যেত। পরে কুমিল্লা শহর বাইপাস করে বিশ্বরোড হলো। ’৮৮-এর বন্যায় দীর্ঘদিন এ মহাসড়কটি ডুবে ছিল। পরে মহাসড়কটি উঁচু করা হয়। এখন তো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হয়েছে। তবে সময়ের দাবি ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে করার। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে তার কোনো বিকল্প নেই।

এখন অনেকে বিশ্বাসই করবেন না। ছেলেবেলায় দাউদকান্দি থেকে ঢাকা আসতে আমাদের তিনটি ফেরি পেরোতে হতো—দাউদকান্দি, মেঘনা, কাঁচপুর। কাঁচপুরে সেতু হয়েছে অনেক আগেই। আমরা ঢাকায় আসার পথে কাঁচপুর সেতুর ওপরে উঠলেই মতিঝিলের আকাশচুম্বী ভবনগুলো দেখতে পেতাম। তখন মনে হতো, ঢাকা চলে এসেছি। তবে দাউদকান্দি আর মেঘনা ফেরি একসময় এই পথে চলাচলকারীদের জন্য আতঙ্ক ছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হতো। ঢাকা-কুমিল্লার ৯০ কিলোমিটারের দূরত্ব অতিক্রম করতে কখনো কখনো সাত-আট ঘণ্টাও লেগে যেত। মেঘনা ও দাউদকান্দি সেতু হওয়ার পর এই দূরত্ব নাটকীয়ভাবে তিন ঘণ্টায় কমে আসে। আর চার লেনে উন্নীত হওয়ার পর এই এখন কার্যত দুই ঘণ্টার দূরত্ব। সাত-আট ঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টায় নেমে আসাটা দারুণ উন্নতি বটে।

তারপরও সমস্যা কিছু রয়ে গেছে। এ সমস্যাগুলো রাস্তার নয়, ব্যবস্থাপনার। কিছুটা কর্তৃপক্ষের, কিছুটা আমাদের। আমাদেরটাই আগে বলি। এত চমৎকার একটা মহাসড়ক বানিয়ে দিয়েছে সরকার। কিন্তু সেটা ঠিকঠাকভাবে ব্যবহার করার মতো স্মার্ট হতে পারিনি আমরা। মহাসড়কের গা ঘেঁষেই দোকানপাট, এমনকি ঘরবাড়িও বানিয়ে রেখেছি। একসময় এ মহাসড়কে নিয়মিত দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি হতো। ডিভাইডারসহ চার লেনে উন্নীত করার পর দুর্ঘটনা অনেক কমে এসেছে। এখন আর মুখোমুখি সংঘর্ষের সুযোগ নেই বললেই চলে। মহাসড়ক বানানোই হয়েছে দ্রুতগতির যান চলাচলের জন্য। কিন্তু আমরা রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি নিয়েও মহাসড়কে উঠে যাই। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো, উল্টো দিক থেকে যানবাহন। ডিভাইডারসহ চার লেনে উন্নীত হওয়ার পরও আমরা উল্টো দিকে গাড়ি চালাই। ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলা একটি গাড়ির সামনে যখন উল্টো দিক থেকে আসা একটি রিকশা পড়ে, তখন দুর্ঘটনা ঠেকানো কঠিন। আমি নিজে বহুবার এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। কোনোরকমে দুর্ঘটনা ঠেকানো গেছে বটে, তবে মহাসড়কে গাড়ি চালানোর আনন্দটা আর থাকে না। সারাক্ষণই তটস্থ থাকতে হয়, উল্টো দিক থেকে কিছু এলো কি না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফুট ওভারব্রিজ আছে, নির্দিষ্ট স্থান পরপর ইউটার্নও আছে। কিন্তু আমরা ফুট ওভারব্রিজে ওঠার কষ্টটুকুও করি না। রাস্তা পেরোতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ি। দুই কিলোমিটার দূরের ইউটার্ন ব্যবহার না করে উল্টো দিকে চালিয়ে দিই। শুধু যে রিকশা, ঠেলাগাড়ি তাই নয়; মাঝেমধ্যে প্রাইভেটকার, এমনকি বড় বড় বাস-ট্রাকও উল্টো দিকে চলে আসে। আর এ প্রবণতা শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নয়; সব মহাসড়ক, এমনকি এক্সপ্রেসওয়েতেও উল্টো দিকে গাড়ি চলার প্রবণতা আছে। ঢাকার ভেতরেই যে পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে, সেখানেও সমানে উল্টো দিক থেকে গাড়ি চলে। এমনকি পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতেও একই চিত্র দেখেছি।

ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে আমাদের গর্বের নির্মাণ। এটি আমাদের দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। আমার মন খারাপ থাকলেই আমি বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়েতে যাই। মন ভালো হয়ে যায়। বিদেশ বিদেশ লাগে। পদ্মা সেতুকে সংযুক্ত করা এই গর্বের এক্সপ্রেসওয়ে এখন পরিণত হয়েছে মৃত্যুর মহাসড়কে। এক বছরে ১৩৫টি দুর্ঘটনায় ১৩১ জন মানুষ মারা গেছে। সত্যিকারের এক্সপ্রেসওয়েতে মানুষের ঢোকারই সুযোগ থাকার কথা নয়। সেখানে আমরা ইচ্ছেমতো যেখানে-সেখানে রাস্তা পার হই। ইচ্ছেমতো বাসস্টপ বানিয়ে নিয়েছি। এক্সপ্রেসওয়ে বানানোর পর যদি দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু বেড়ে যায়, তাহলে তো এর উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। দোষ তো এক্সপ্রেসওয়ের না। দোষ হলো আমাদের, ব্যবস্থাপনার। শুধু এক্সপ্রেসওয়ে বানালেই হবে না, সেটা ব্যবহার করার মতো স্মার্ট ও সতর্ক হতে হবে আমাদের। না হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ দিয়ে তা নিশ্চিত করতে হবে।

তবে গত সপ্তাহে একবেলার জন্য কুমিল্লা যেতে-আসতে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো, তা মনে থাকবে অনেক দিন। তবে এ প্রবণতা নতুন নয়। শুক্রবার দুপুরের দিকে কুমিল্লার উদ্দেশে রওনা হয়েছি। মনে মনে দুই ঘণ্টা জার্নির পরিকল্পনা। কিন্তু মোগড়াপাড়া পর্যন্ত যেতেই জ্যাম আটকে দিল পথ। এমনিতে ঢাকা থেকে কুমিল্লা যাওয়ার পথে মেঘনা সেতুতে টোল দিতে হয়। আর ফেরার পথে দাউদকান্দি। যাওয়ার পথে মেঘনা সেতুর টোল প্লাজা পর্যন্ত যেতেই জান বেরিয়ে যাওয়ার দশা। অনেক সময় কোনো দুর্ঘটনা হলে যানজটের সৃষ্টি হয়। কিন্তু সেদিন তি-চার কিলোমিটার যানজটের কোনো কারণ ছিল না। পিঁপড়ার গতিতে এগিয়ে দেখলাম, সব জ্যামের উৎস টোল প্লাজা। শেষ পর্যন্ত কুমিল্লা যেতে লাগল চার ঘণ্টা। সেখানে ঘণ্টা চারেকের পারিবারিক কাজ শেষে ফেরার পথে একই তিক্ত অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হলো। মধ্যরাতেও মহাসড়কে যানজট। দাউদকান্দির সেতুর টোল প্লাজার জ্যাম শহীদনগর পর্যন্ত চলে এসেছে। ছেলেবেলার ফেরিঘাটে জ্যামের স্মৃতি ফিরে এলো যেন। ফেরার পথেও সব জ্যামের উৎস টোল প্লাজা। ছুটির দিনের বাড়তি গাড়ির চাপ সামলাতে পারেনি টোল প্লাজা।

টোল প্লাজায় এ যানজটের অভিজ্ঞতা অবশ্য শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নয়। সব টোল প্লাজায়ই কমবেশি জট লাগে। আমরা হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে আধুনিক, ডিজিটাল হাইওয়ে, এক্সপ্রেসওয়ে, এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে বানাব আর টোল নেব অ্যানালগ পদ্ধতিতে। তাহলে কোনো লাভ হবে না। উন্নয়নের সব গতি আটকে যাবে টোল প্লাজায়। আমি না হয় ব্যক্তিগত কাজে, ব্যক্তিগত গাড়িতে কুমিল্লা গেছি। যেতে আসতে বাড়তি চার ঘণ্টা সময় লেগেছে। বিরক্তি ছাড়া আমার কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু রপ্তানিমুখী পণ্যবাহী যানের যদি রাস্তায় চার ঘণ্টা বেশি সময় লাগে, তাহলে তা অর্থনীতির গতি শ্লথ করে দেবে। অগ্রগতির চাকা আটকে দেওয়ার জন্য আমাদের অনেক আমলাতান্ত্রিক কায়দা-কানুন আছে। অন্তত রাস্তাটা যদি একটু সচল রাখতে পারি, তাহলেও তো ক্ষতি একটু কম হয়।

হাইওয়েগুলো নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন রাখার জন্য আলাদা পুলিশ আছে। গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ক্যামেরা বসানো হয়েছে। সেই ক্যামেরায় কি উল্টো দিক থেকে আসা যানবাহনগুলো ধরা পড়ে না? আমার অভিজ্ঞতা হলো, উল্টো দিক এমন নির্বিঘ্নে গাড়ি চলে, মনেই হয় না এটা বেআইনি। এ ব্যাপারে হাইওয়ে পুলিশকে কঠোর হতে হবে। টোল প্লাজায় ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আনতে হবে। একটি নিরাপদ ও সচল সড়ক এখন সবার চাওয়া।

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় খবর